বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে বৈদেশিক সহায়তা হ্রাসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা কার্যক্রম এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন সময় এসেছে স্থানীয় উদ্ভাবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেওয়ার, আমাদের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদকে কাজে লাগানোর। টেকসই অগ্রগতির জন্য আত্মনির্ভরশীলতা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং ন্যায্য, মর্যাদা ও জাতীয় মালিকানার ওপর ভিত্তি করে সরকার-বেসরকারিসহ উন্নয়ন সংস্থাসহ নাগরিক সংগঠকদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব প্রয়োজন কেবল নির্ভরতা নয়।
সোমবার (২৮ জুলাই) রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে এই আহ্বান জানানো হয়।
‘উন্নয়ন তহবিল খাতের পট পরিবর্তনে কমিউনিটি সহায়তা জোরদারকরণ’ বিষয়ক এই বৈঠকের আয়োজন করে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ।
এতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন (সিএসও), জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, বেসরকারি খাতের কর্মকর্তা, জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, নীতি বিশ্লেষকসহ উন্নয়ন খাতের গবেষকরা অংশ নেন।
আলোচনায় বক্তারা উন্নয়ন তহবিলের পরিবর্তিত ধরন, বৈদেশিক সহায়তা হ্রাসের প্রভাব, এবং সিএসওদের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা পালনে সরকারের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। পরিবর্তিত এই সংকট মোকাবিলায় নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোর (সিএসও) ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন, কৌশলগত পদক্ষেপ এবং টেকসই অর্থায়নের বিকল্প পথ খুঁজে বের করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুষ্ঠানে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থায়নের কারণে আমাদের কমিউনিটিগুলো, বিশেষত নারী ও শিশুরা, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রোহিঙ্গা শিবিরে এর প্রভাব স্পষ্ট। বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে এখন আমাদের নিজেদের সম্পদ কাজে লাগাতে হবে। ক্রাউডসোর্সিং, সিএসআর সম্প্রসারণ, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে আমরা কমিউনিটিকে শক্তিশালী করতে পারি। আসুন, সম্মিলিতভাবে বিকল্প পথ তৈরি করি, যা তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।
ব্র্যাকের সিনিয়র ডিরেক্টর কেএএম মোর্শেদ উল্লেখ করেন, তহবিলের পরিবর্তিত প্রকৃতির কারণে অভ্যন্তরীণ তহবিল গঠন জরুরি। এনজিও এবং কমিউনিটির মধ্যে আস্থার ঘাটতি দূর করতে সিএসও-দের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রভাব প্রমাণ করতে হবে। সরকারি সমন্বয়, এআই ব্যবহার, এবং জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সিএসও ফলাফল সংযুক্ত করা অপরিহার্য।
তিনি অনুদানে কর ছাড়, পিপিপিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো, এবং ছোট এনজিওদের জন্য সংগ্রহ নীতি সংস্কারের আহ্বান জানান। তিনি জোর দেন যে, সিএসওদের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী থেকে বিশ্বাসযোগ্য উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া উচিত, যাতে আস্থা পুনরুদ্ধার হয় এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তন আসে।
নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এস এম মনজুরুল হান্নান খান বলেন, আমাদের অন্যান্য নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও সক্ষমতার অভাবে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো জলবায়ু অর্থায়ন পেতে সজ্জিত নয়। পরিবেশ অধিদপ্তরে বাজেট অপ্রতুল (মাত্র ০.৩৮%) এবং সিএসও-সরকার সমন্বয় দুর্বল। শক্তিশালী সহযোগিতা ও কমিউনিটি প্রতিনিধিত্ব জরুরি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, এলডিসি উত্তরণের জন্য সরকারের 'স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি'-তে সিএসওদের অংশগ্রহণের সুস্পষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রাসঙ্গিকতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, করের ফাঁক পূরণ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া, খরচ কমানো, দ্বৈততা এড়ানো এবং প্রযুক্তিভিত্তিক মানবিক কাজ গ্রহণ করা উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান অর্থায়ন মডেল পর্যালোচনা এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সক্ষমতা উন্নয়নকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা জরুরি। সিএসওদের স্বল্পমেয়াদী সহায়তা নির্ভরতা ছেড়ে টেকসই ব্যবসায়িক মডেল গড়ে তুলতে হবে, যা বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন খান বলেন, জলবায়ু অর্থায়নের নামে ওডিএ (অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্টেন্স) সংকুচিত হচ্ছে, তবে আইসিজের (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাসটিস) সাম্প্রতিক রায় নতুন সুযোগ এনেছে। আমাদের নির্গমনকারীদের ওপর কার্বন ট্যাক্সের জন্য চাপ দিতে হবে, প্রকৃতি-বান্ধব অনুদান অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সহায়তা মডেলগুলোকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, এবং নাগরিক সমাজ-কমিউনিটি তত্ত্বাবধানকে শক্তিশালী করতে হবে।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সায়েদা নাসরিন পারভীন বলেন, সরকার ও এনজিওদের মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য। তবে সরকারি দুর্নীতি একটি বড় বাধা যা অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে। এনজিওদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ এবং উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি দিলে তাদের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
অ্যাকশন এইড আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ সোসাইটির চেয়ারপার্সন ইব্রাহিম খলিল আল-জায়াদ বলেন, তহবিল আমাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দু এবং আত্মনির্ভরশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি সরকারের কাছে অনুদানের জন্য কর ছাড় প্রবর্তন এবং প্রবাসী অনুদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ক্ষমতা প্রদানের আহ্বান জানান। তিনি উল্লেখ করেন, নীতিগত ফাঁকের কারণে ৭ বিলিয়ন ডলারের যাকাত তহবিল অব্যবহৃত রয়ে গেছে। দাতা নির্ভরতা কমাতে মিশ্র অর্থায়ন (ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্স), কর্পোরেট অংশীদারিত্ব এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, নারীবাদী নেতৃত্ব প্রয়োজন।
আলোচনায় বক্তারা সিএসওদের সহায়তায় সরকারের জন্য কয়েকটি কৌশল প্রস্তাব করেন। এগুলো হলো বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক সিএসআর নীতি প্রবর্তন বা প্রণোদনা কাঠামো তৈরি, এনজিওর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও প্রভাব মূল্যায়নে প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ এবং স্বচ্ছতা ও সহজে বাস্তবায়নের জন্য পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি।
পিএ/টিএ