জ্ঞানের দীপ্ত প্রতীক: ড. কাজী মোতাহার হোসেন

তথাকথিত আধুনিকতার বেগে আমরা যেন ক্রমশ বিস্মরণে নিপতিত হচ্ছি—অন্ধকারে হারিয়ে ফেলছি সেই আলোকপ্রতিম পুরুষদের, যাঁদের মেধা, মনন আর মনুষ্যত্বের দীপ্তি একদিন আমাদের জাতিসত্তার নির্মাণে অবদান রেখেছিল। এমনই এক আলোকবর্তিকা ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন—একাধারে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, দাবাড়ু, সংগীতানুরাগী এবং মানবিকতা ও মুক্তচিন্তার নির্ভীক কণ্ঠ। ৩০ জুলাই তাঁর জন্মদিন—কিন্তু সেই দিনটি নিঃশব্দে চলে যায়, জাতীয় গণমাধ্যমে তাঁর স্মরণ নেই, সামাজিক মাধ্যমেও গভীর নীরবতা। ক’জন মানুষ তাঁকে মনে রাখেন? ক’জন তাঁর নাম উচ্চারণ করেন কোনো প্রেরণার বোধ থেকে? এই প্রশ্নগুলো আমাদের মানসপটে কেবল দুঃখ নয়, একধরনের আত্মোপলব্ধির আহ্বান ছুড়ে দেয়।


১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কাজী মোতাহার হোসেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষার ক্ষীণ আলোয় যাত্রা শুরু করা এই শিশুটি একদিন হয়ে উঠলেন জ্ঞানের দীপ্ত মশাল—সে কথা হয়তো তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু প্রতিভা যদি প্রকৃত হয়,অনিবার্যভাবেই তার প্রকাশ ঘটে। ঠিক তেমনি মোতাহার হোসেনের জীবনে জেগে ওঠে চিন্তার জাগরণ ছিলো যুক্তির দীপ্তি এবং প্রগতিশীল চেতনার শুদ্ধতম ভাষা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯২১ সালে তিনি যোগ দেন নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরুটা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের ডেমোনেস্ট্রেটর হিসেবে। কিন্তু এটি ছিল কেবল এক সূচনা। শীঘ্রই তিনি গড়লেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেই একটি নতুন অধ্যায়—পরিসংখ্যান বিভাগের জন্ম। শুধু জন্মই নয়, এই বিভাগে গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আন্তর্জাতিক পরিসরে সমাদৃত হয়। তাঁর উদ্ভাবিত ‘হুসাইন চেইন রুল’ নামক সূত্র আজও পরিসংখ্যান শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদণ্ড। এই সূত্র গণনামূলক প্রক্রিয়ায় নির্ভুলতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে অভাবনীয় ভূমিকা রাখে। তিনি ছিলেন গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞ ও অধ্যবসায়ী, আবার পাঠদানে ছিলেন নিরহঙ্কার ও প্রেরণাদায়ী।

তবে সংখ্যার শুষ্ক পরিসরে থেমে থাকেননি তিনি। জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বহুমাত্রিক। বিজ্ঞান ও দর্শনের মাঝে কোনো বিরোধিতা খুঁজে পাননি তিনি। বরং তাঁর বিশ্বাস ছিল—যুক্তি, সৌন্দর্য ও মানবতা একই বৃন্তে ফোটা তিনটি পুষ্প। তাই তো তিনি বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি লিখেছেন দর্শন নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে, সমাজ নিয়ে। তাঁর রচনায় যে ভাবনার বিস্তার, তা আজও পাঠকের হৃদয়কে অনুরণিত করে। “আমাদের শিক্ষা”, “বিজ্ঞান ও দর্শন”, “জ্ঞান ও যুক্তি”—এইসব গ্রন্থে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে; যুক্তির আলোয় তিনি নিরীক্ষণ করেছেন সামাজিক গোঁড়ামি ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে।

তাঁর লেখায় আমরা এমন সব মর্মস্পর্শী ও চিন্তন-উদ্রেককারী বাণী পাই, যা যুগে যুগে আলো জ্বালাতে সক্ষম। যেমন তিনি বলেন—

এইসব বাণীতে স্পষ্ট হয় তাঁর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ভাবনা। শুধু জ্ঞানের বাহার নয় বরং চিন্তার মুক্তি, মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ এবং সংস্কৃতির সৌন্দর্যই ছিল তাঁর আদর্শ।

ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন প্রকৃত মানবতাবাদী। তিনি গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ হলেও ছিলেন গোঁড়ামিবিরোধী। তিনি বুঝতেন, যে ধর্মে মানবতার জায়গা নেই, সেই ধর্ম আত্মবিবর্জিত। আর যে বিজ্ঞান মানুষের আত্মার অন্বেষণ করে না, সে বিজ্ঞান কেবল যন্ত্রের নির্মাণমাত্র। তাই তাঁর জীবনদর্শনে আমরা দেখি একটি ভারসাম্য—যেখানে যুক্তি, বিশ্বাস, নান্দনিকতা ও মানবিকতা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।

তাঁর সাংস্কৃতিক চেতনা ছিল পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন সংগীতপ্রেমী এক শিল্পমনস্ক মানুষ। এক সময়ের কট্টর মুসলিম সমাজে, যখন সংগীতচর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হতো, তখন তিনি ঠুংরি, খেয়াল, টপ্পা ও সেতারে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁর এই চর্চা কেবল রুচির বিষয় ছিল না, ছিল এক ধরণের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদও—একটি বন্ধ সমাজে মুক্তস্বরের উচ্চারণ। তাঁর সংগীতপ্রীতি, তাঁর সাহিত্যমনস্কতা এবং সাংস্কৃতিক অনুরাগ তাঁকে সেই সময়ের প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রভাগে দাঁড় করায়।

তাঁর ক্রীড়াজীবনও ছিল বিচিত্র। দাবায় তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় চ্যাম্পিয়ন, আবার বাংলাদেশের দাবা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান। দাবা ছাড়াও তিনি পারদর্শী ছিলেন লন টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল ও সাঁতারে। এমনকি এই সব ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যুৎপত্তি শুধু খেলার পরিধিতে সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং শৃঙ্খলা, ধৈর্য, কৌশল ও জ্ঞান-অনুশীলনের প্রকাশরূপ হিসেবেও বিবেচিত।

ড. মোতাহার হোসেন ছিলেন যুক্তিবাদের পক্ষে নির্ভীক কণ্ঠস্বর। তিনি ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক, ‘শিখা’ পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর সাথে গভীর বন্ধুত্ব ছিল কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী আবদুল ওদুদ, কবি আবদুল কাদির, সৈয়দ আবুল হোসেন প্রমুখ মনীষীদের সঙ্গে। এইসব আলোকিত মানুষদের সাহচর্যে তিনি নিজেও হয়ে উঠেছিলেন চিন্তার এক দীপ্ত জ্যোতির্ময় পুরুষ।

তাঁর মৃত্যুও ছিল এক শোকাবহ প্রস্থান—১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক, জাতীয় অধ্যাপক এবং বাংলাদেশের চিন্তাচর্চার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। কিন্তু আমরা কি তাঁকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করি? আমাদের পাঠ্যপুস্তকে, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, এমনকি আমাদের জাতীয় দিবসের আলোচনায় কি তাঁর কথা থাকে? নাকি তিনি কেবল কালের অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আরেক নাম?

এই আত্মসমালোচনার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলতে হয়—কাজী মোতাহার হোসেন কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দর্শন। তিনি ছিলেন যুক্তির পক্ষে এক দীপ্ত প্রতিবাদ, সৌন্দর্যের পক্ষে এক অনুপম শ্রদ্ধা এবং মানবতার পক্ষে এক নীরব অথচ অনড় আহ্বান। তাঁকে স্মরণ মানে কেবল অতীতকে স্মরণ নয়—বরং ভবিষ্যতের দিশা খোঁজার একটি প্রচেষ্টা।

সন্ধ্যার শেষ রঙের মতোই নিঃশব্দে তিনি হারিয়ে গিয়েছেন সময়ের প্রান্তর থেকে—কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আলো আজও জ্বলজ্বল করে কিছু মুষ্টিমেয় চিন্তাশীল হৃদয়ে। প্রশ্ন হলো, সেই আলোকে আমরা কী কেবল মোমের মতো নিঃশেষ হতে দেব, নাকি দীপ থেকে দীপ জ্বালিয়ে তা পৌঁছে দেব পরবর্তী প্রজন্মের হৃদয়ে? জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশ কেবল পরিকাঠামো বা প্রযুক্তিতে নয়, মননের গভীরতায়, যুক্তির উন্মুক্ততায় এবং সংস্কৃতির সারল্যে নিহিত। আর এই পথেই জেগে উঠবেন আমাদের ভিতরের কাজী মোতাহার হোসেনেরা—তাঁরা ফিরবেন চিন্তার শুদ্ধতায়, বাকস্বাধীনতায়, আর সৌন্দর্যের অনুরাগে।

লেখক:
বাহাউদ্দিন গোলাপ
ডেপুটি রেজিস্ট্রার,
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আজ দুপুরে হাইকোর্টের ২২ বিচারপতির শপথ গ্রহণ Nov 12, 2025
img
২০২৬ সালে হজ করতে পারবেন ৭৮৫০০ বাংলাদেশি Nov 12, 2025
img
১২ নভেম্বর: ইতিহাসে এই দিনে আলোচিত ঘটনা Nov 12, 2025
img
পেটের চর্বি কমায় আদার রস Nov 12, 2025
img
সুখবর পেল আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ে Nov 12, 2025
img
স্বর্ণ কিনবেন? জেনে নিন দেশে কত দামে বিক্রি হচ্ছে আজ Nov 12, 2025
img
বিএনপির নামে কেউ লুটতরাজ করলে দলে রাখা হবে না : জয়নাল আবেদিন Nov 12, 2025
img
নির্বাচন বানচালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে : আমিনুল হক Nov 12, 2025
img
আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান! Nov 12, 2025
img
বিশ্বকাপের আগেই ফিরছেন শাদাব খান Nov 12, 2025
img
ঢাকায় নাগরিক সমাজ সম্মেলনে ৬ অঙ্গীকার Nov 12, 2025
img
“স্পর্শ ছাড়াই সঙ্গীত কাঁদাতে পারে”- অরিজিৎ সিং Nov 12, 2025
img
জামায়াতের হাতে আওয়ামী লীগের বিচার আমি চাই না: মো. তারেক রহমান Nov 12, 2025
img
কষ্টের মধ্যেই সাফল্যের পথ খুঁজে পেলেন বোমান ইরানি Nov 12, 2025
img
কারামুক্তি পেলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী Nov 12, 2025
img
রংপুরে পুলিশের অভিযানে আ.লীগের ৪ নেতা গ্রেপ্তার Nov 12, 2025
img
কটাক্ষের শিকার জনপ্রিয় সুরকার এ আর রহমান Nov 12, 2025
img
শ্রুতি হাসানের কণ্ঠে ‘সঞ্চারী’ ভক্তদের মাতাল Nov 12, 2025
img
‘নন ভায়োলেন্স’-এর বিশেষ গান দিয়ে ফের বড় পর্দায় ফিরছেন অভিনেত্রী শ্রিয়া Nov 12, 2025
img
ভারণাসি না সঞ্চারী?’- টলিউডের নতুন সিনেমার নাম নিয়ে কৌতূহল Nov 12, 2025