কুমিল্লার মুরাদনগরে মা-ছেলে-মেয়েকে হত্যার নির্দেশদাতা অভিযোগ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাবা বিল্লাল মাস্টারকে গ্রেপ্তারের দাবি তোলা হয়েছে। সোমবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য রুমা আক্তার এই দাবি জানান।
এর প্রেক্ষিতে, এই ট্রিপল মার্ডার নিয়ে নিরপেক্ষভাবে উভয় পক্ষের বক্তব্য নিয়ে ফ্যাক্ট ভিত্তিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আজ রাত ৭টা ৩৯ মিনিটে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ আহ্বান জানান তিনি। এতে দুটি ভিডিও ক্লিপও যুক্ত করেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেসবুক পোস্টে লেখেন– মুরাদনগরের ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় আজ প্রায় দেড় মাস পর সংবাদ সম্মেলনে স্ক্রিপ্ট পড়ে আমার বাবার গ্রেপ্তার চাইলেন সেই পরিবারের একজন। অথচ কিছুদিন আগে বাংলাভিশনে প্রচারিত রিপোর্টের সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু আসামিরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না সেহেতু উপদেষ্টার বাবা জড়িত থাকলেও থাকতে পারে।’ (যদিও প্রায় ৯ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে)।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আরও লেখেন– সংযুক্ত প্রথম ভিডিওটি আজ স্ক্রিপ্ট পড়ে গ্রেপ্তার চাওয়া ভিক্টিমের, যেখানে তিনি বলছেন ‘উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলমের বাসায় মিটিং করে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।’ অবাক করা বিষয় হলো– আজকের সংবাদ সম্মেলনে তার বিচার চাওয়া হয়নি!
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উল্লেখ করেন– দ্বিতীয় ভিডিওতে মার্ডারে স্ত্রী ও দুই সন্তান হারানো বাবা বলছেন, ‘ঘটনার পর থেকেই উপদেষ্টা ও তার বাবার নাম মামলায় দিতে এবং মিডিয়ায় বক্তব্যে বলতে চাপ ও প্ররোচনা দিচ্ছেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা।’
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আরও উল্লেখ করেছেন– ‘আজ স্ক্রিপ্ট লিখে সেটা পড়ানো হলো। এবং যেই ট্রিপল মার্ডারের পরিকল্পনা হলো বিএনপি নেতার বাসায়, তার দায় দিয়ে গ্রেপ্তার চাওয়া হলো বাবার। আমাদের ফাঁসানোর প্ররোচনায় পুরো পরিবার সায় না দিলেও, একাংশ সায় দিল। প্রথমদিকে ভিক্টিমদের কোনো সাক্ষাৎকারে বাবার কথা বলা হয়নি। পরবর্তীতে রাজনৈতিক চাপ ও প্ররোচনায় নাম নিয়ে নোংরা খেলা শুরু হলো।’
গণমাধ্যমের প্রতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার অনুরোধ জানিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া লেখেন– আমি বাংলাদেশের যেকোনো টিভি কিংবা পত্রিকাকে আহ্বান জানাচ্ছি, নিরপেক্ষভাবে দুপক্ষের বক্তব্য নিয়ে ফ্যাক্ট ভিত্তিক অনুসন্ধান করুন। এলাকায় যান, এলাকাবাসীর কথা শুনুন৷ আমাদের কাছে থাকা তথ্য, উপাত্তগুলো দেখুন। ট্রিপল মার্ডারসহ যেসব অভিযোগ একপাক্ষিকভাবে বাংলাভিশনের রিপোর্টে আনা হয়েছে– প্রতিটি যে মিথ্যা ফ্রেমিং, এর প্রমাণ পেয়ে যাবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে রুমা আক্তারের বক্তব্য
মুরাদনগরে মা-ছেলে-মেয়েকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাবা বিল্লাল মাস্টারকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে নিহতদের পরিবারের সদস্য রুমা আক্তার সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি দাবি করেন, ভুক্তভোগী হওয়া সত্ত্বেও ন্যায়বিচার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিচারের পাশাপাশি নিজের পরিবারের নিরাপত্তাও চেয়েছেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে রুমা আক্তার বলেন, ‘বিচার চাওয়ার তো অধিকারই নেই, উল্টো নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কারণ এই হত্যাকাণ্ডে শুরু থেকে মদদ দিয়েছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাবা বিল্লাল মাস্টার। তাঁর প্রভাব এবং সাহসে এমন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন শিমুল চেয়ারম্যান ও তাঁর দোসরেরা।’
রুমা আক্তার দাবি করেন, ‘প্রথমে আমার মাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরে ছেলে-মেয়ে বিচার চাইতে পারে এমন চিন্তা করে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রুমা আক্তার বলেন, ‘আমার মা একটি বিল্ডিং নির্মাণ করার কারণেই স্থানীয়দের সঙ্গে হিংসা শুরু হয়। শিমুল চেয়ারম্যান চেয়েছিল, আমাদের বিল্ডিং তাঁর মাধ্যমে কন্টাক্ট দিয়ে, তাঁর লোকদের দিয়ে কাজ করাতে। আমার মা তা করেননি। কারণ আমার বাবা-ভাই বিদেশ থেকে অল্প-অল্প টাকা পাঠিয়েছে। আমার মাসহ আমরা তিন বোন দু-একজন মিস্ত্রি রেখে আস্তে আস্তে কাজ করিয়েছি। সেজন্য শিমুল-বিল্লাল কয়েকবার চাঁদা নেওয়ার জন্য আমার মায়ের কাছে লোক পাঠায়। চাঁদা না দেওয়া আমাদের বাড়ির গ্লাস, কারেন্টের লাইন কেটে ফেলা হয়। এ নিয়ে কুমিল্লা ডিবি অফিসে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়।’
রুমা আক্তার আরও দাবি করেন, ‘হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে, মোবাইল চুরির ঘটনার নিয়ে হট্টগোল শুরু হয়। একজনের ঘরে মোবাইল চুরির ঘটনায় আমাদের বাড়ির পাশের দোকানে একটি ছেলেকে বেধড়ক মারধর করা হয়। অভিযুক্ত ছেলের বাবা কোনোভাবে ছেলে বাঁচাতে না পেরে আমার মায়ের কাছে সাহায্য চায়। তখন আমার মা ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেন— চোর মরে গেলে আমরা আশপাশের সবাই ফেঁসে যাব। হয় তাঁকে ছেড়ে দাও, নাহলে পুলিশে দাও। এ কথা বলার সাথে সাথেই সেখানে থাকা বাচ্চু মেম্বার, শরীফ, আসিফসহ সবাই আমার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুই চোরের পক্ষ নিছিস, তুই নিজেও চোর। পরে আমার ভাই ঘটনাস্থল থেকে মাকে উদ্ধার করে। অভিযুক্ত ছেলের বাবা থানায় অভিযোগ করলে বাচ্চু মেম্বারসহ অন্যান্যরা আমার মাকে সন্দেহ করে।’
রুমা আক্তার বলেন, ‘এরপর ২ জুলাই রাতে শিমুল চেয়ারম্যান, আনু মেম্বার, মতিনসহ কয়েকজনের উপস্থিতিতে রবিউল ও শরীফের আহ্বানে এক গোপন বৈঠকে আমার মাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখানে বেশ কিছু টাকাও লেনদেন হয়।’
পরে রুমা আক্তার সংবাদ সম্মেলনে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন। পাশাপাশি হত্যা পরবর্তী হত্যাকারীদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেওয়া, প্রভাব বিস্তার, নির্যাতন, ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের ঘটনা তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের বাইরে পরিবারের কারও বক্তব্য কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা উপদেষ্টা আসিফের চাপের ফলে হবে বলে বিবেচনা করার জন্যও সতর্ক করেন রুমা আক্তার।