চাঁদ কি সত্যিই আমাদের প্রভাবিত করে?

সভ্যতার সূচনালগ্ন হতেই মানুষের মনের উপর এক রহস্যময় প্রভাব আছে চাঁদের। যুগ যুগ ধরে মানুষের বিশ্বাস যে, সত্যিকার অর্থেই মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রয়েছে পৃথিবীর একমাত্র এই উপগ্রহটির। আর তাই জগত জুড়ে বহু লোকের কাছে চাঁদ লাভ করেছে গুরুত্বপূর্ণ এক দেবীর মর্যাদা। চাঁদ নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর, লেখা হয়েছে বহু গল্প-গান-কবিতা কিংবা উপন্যাস।

বিখ্যাত জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি লিখেছেন, “চাঁদ সবার চেয়ে কাছ থেকে সবার চেয়ে বেশি সময় ধরে পৃথিবীকে দেখে আসছে। তাই এটি অবশ্যই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ও কর্মকাণ্ডের সাক্ষী।”

পৃথিবী ও তার প্রকৃতির উপর চাঁদের কিছুটা প্রভাব অবশ্য রয়েছে, যা প্রাচীনকাল হতেই মানুষ স্বীকার করে নিয়েছিল। যেমন- চাঁদ ও পৃথিবীর পারস্পরিক মধ্যাকর্ষীয় টানের প্রভাবে সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। আর যেহেতু পৃথিবীর উপর চাঁদের এরূপ প্রভাব রয়েছে, তাই মানুষ বিশ্বাস করে যে, এটি মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের নানাদিক প্রভাবিত করতে সক্ষম।

আসুন জেনে নেই বাস্তবে চাঁদ আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্যকে কতটা প্রভাবিত করে-

ঋতুস্রাব এবং চাঁদের সম্পর্ক
এখনও বহুলোক ‘ঋতুচক্র’কে (নারীদের ঋতুস্রাবের আবর্তনকাল) ‘চন্দ্রচক্র’ (পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ার সময়কাল) হিসেবে বলে থাকেন এবং অনেকে এখনও বিশ্বাস করেন যে, একটির সঙ্গে অন্যটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

ঋতুচক্রকে চন্দ্রচক্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করার অন্যতম একটি কারণ হলো, নারীদের গড় ঋতুচক্রের সময়কাল ২৮ দিন। অন্যদিকে পৃথিবীকে ঘিরে একবার পরিভ্রমণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৭ দিন, ৭ ঘণ্টা, ৪৩ মিনিট। এর থেকে এই ধারণা উদ্ভূত হতে পারে যে, নারীর ঋতুচক্র আসলে চন্দ্রচক্রের দ্বারা প্রভাবিত।

এদিকে, প্রায় ৭৫ লাখ ঋতুচক্রের উপর চালানো ‘হেলথক্লু’র এক গবেষণা বলছে- চন্দ্রচক্রের সঙ্গে ঋতুচক্রের কোনো সম্পর্কই নেই। সংস্থাটির গবেষক ড. মারিযা ভ্লাজিক হুইলার এ বিষয়ে মন্তব্য করেন, “তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি যে, চন্দ্রচক্রের কোনোরূপ তোয়াক্কা না করেই ঋতুস্রাব মাসের যে কোনো সময় শুরু ও শেষ হয়।”

গবেষকরা আরও বলেন, তাই ঋতুস্রাবের সঙ্গে চন্দ্রচক্রের সামঞ্জস্যকে নিতান্তই সমাপতন বলতে হবে। ঋতুস্রাব চক্র ২১ দিন থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং এদের স্থায়িত্ব বয়স ও হরমোন পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে।

চাঁদ ও ঘুমের মধ্যকার সম্পর্ক
জনমনে প্রচলিত আরেকটি জনপ্রিয় বিশ্বাস হলো- পূর্ণিমার পূর্ণচাঁদ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, মানুষকে করে তোলে নিশাচর। ২০১৪ সালে স্লিপ মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত মানুষের ঘুমের উপর চাঁদের প্রভাব বিষয়ক একটি গবেষণা প্রকল্পে ৩১৯ জন অংশগ্রহণ করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ভরা চাঁদের সময় অংশগ্রহণকারীদের অনেকের ঘুম হালকা হয়ে যায়। অর্থাৎ তারা হয়তো জেগে থাকেন অথবা হালকা ঘুমে নিমজ্জিত হয়ে রাত পার করেন।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্রিশ্চিয়ান কাজোচেন এ বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর এই বলে মন্তব্য করেছেন যে, ভরা চাঁদের সময় ঘুমের গঠন, ঘুমের সময় মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড এবং মস্তিষ্কে মেলাটিন ও কোরটিজলের মাত্রায় পরিবর্তন আসে।

বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে ড. কাজোচেন বলেন, “চন্দ্রচক্র মানুষের ঘুমকে প্রভাবিত করে, এমনকি যখন কেউ একজন চাঁদ দেখতে পায় না, এমনকি ভরা পূর্ণিমা সম্পর্কে অবহিতও থাকে না, তখনও সে প্রভাবিত হয়।”

চাঁদের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক
আরেকটি বহু প্রচলিত বিশ্বাস হলো- চাঁদ মানুষের মেজাজ ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এবং ভরা পূর্ণিমার রাতে মানুষ অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ইউরোপিয়ান লোক গাঁথায় উল্লেখ রয়েছে যে, পূর্ণচাঁদের রাতে নেকড়ে-মানবেরা হিংস্র নেকড়েতে পরিণত হতো। আবার পাগল শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘লুনাটিক’ শব্দটিও চাঁদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

যাইহোক, সুইস হেলথ উইকলিতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে, ভরা পূর্ণিমার সঙ্গে মানুষের মেজাজ, মর্জি বা মানসিক স্বাস্থ্যের যোগাযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে দাবি করা হয়েছে। গবেষণাটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের গবেষকরা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ১৭ হাজার ৯৬৬ জনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।

গবেষণায় বলা হয়, “এসব অদ্ভুত বিশ্বাসের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। আমার কাজের জন্য আমিই একমাত্র দায়ী নই, এমন এক ধরণের আদিম ও আবেগতাড়িত বিশ্বাস করার ইচ্ছা থেকেই এসব কুসংস্কারের উৎপত্তি ঘটে।” সূত্র: মেডিক্যাল নিউজ টুডে।

 

টাইমস/এনজে/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পদ্মার এক বাঘাইড় বিক্রি সাড়ে ৪৩ হাজার টাকায় Jul 02, 2025
img
ফের পেছাল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন Jul 02, 2025
img
আল্লু অর্জুনই এখন ভারতের 'ম্যাস আইকন': মধুর ভান্ডারকর Jul 02, 2025
img
ডেঙ্গুতে একদিনে মৃত্যু আরও ১ জনের, হাসপাতালে ৪১৬ Jul 02, 2025
img
কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ জাফর আরও তিন দিনের রিমান্ডে Jul 02, 2025
img
ভুলে গেলে চলবে না, এটা বীর চট্টলা : রাফি Jul 02, 2025
img
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এক ম্যাচ জিতলেই যে সুখবর পাবে বাংলাদেশ Jul 02, 2025
img
রাজধানীতে ডিএনসিসির মশক নিধন অভিযান শুরু Jul 02, 2025
img
সোমালিয়ায় বিমানবন্দরে সামরিক হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত Jul 02, 2025
img
১৮ মিনিটেই মিয়ানমারের জালে বল, ১-০ তে এগিয়ে বাংলাদেশ Jul 02, 2025
img
শাহরুখের নামে ‘কুকুর পালা’ বিতর্কে জবাব দিলেন আমির খান Jul 02, 2025
img
জুলাই পদযাত্রায় এনসিপি নেতাদের কাঁঠাল খাইয়ে আপ্যায়ন করলেন কৃষক Jul 02, 2025
img
কোরিয়ান অভিনেত্রী লি সিও-ই আর নেই Jul 02, 2025
img
ডর্টমুন্ড-রিয়াল ম্যাচে দেখা হচ্ছে না বেলিংহাম ভাইদের Jul 02, 2025
img
বেবিচকের নতুন চেয়ারম্যান মোস্তফা মাহমুদ Jul 02, 2025
img
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার জামিন নামঞ্জুর Jul 02, 2025
img
শিক্ষার্থী ভিসায় ‘সময়সীমা’ আরোপ করতে চান ট্রাম্প Jul 02, 2025
img
শিক্ষার্থীদের আঘাত করার পরিণতি ভালো হবে না : নাহিদ Jul 02, 2025
img
যে কারণে প্রথম ওয়ানডেতে মাঠে নেই রিশাদ Jul 02, 2025
img
৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ পালন না করার সিদ্ধান্ত Jul 02, 2025