ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে মে মাসের সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দেশটির যুদ্ধবিমান আধুনিকায়নকে আরও জরুরি করে তুলেছে। কিন্তু বাস্তবে, ভারতের নতুন ফাইটার জেট অন্তর্ভুক্তির পথ অনেকটাই দীর্ঘ ও জটিল হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, ভারতের প্রধান কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীন গত ১৫ বছরে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রযুক্তিতে চমকপ্রদ অগ্রগতি অর্জন করেছে। তারা বড় সংখ্যায় চেংদু জে-২০ অন্তর্ভুক্ত করেছে, এবং এখন জে-৩৫ নামক নতুন একটি ছোট আকারের ক্যারিয়ার-ভিত্তিক স্টিলথ জেট চীনা নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর হাতে তুলে দিচ্ছে।
চীন একইসঙ্গে তাদের চতুর্থ প্রজন্মের জে-১০, জে-১১, জে-১৫ এবং জে-১৬ বিমানগুলোর সেন্সর, অস্ত্র ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ক্ষমতাও উন্নত করছে। পাইলটদের প্রশিক্ষণেও রয়েছে অনেক উন্নতি।
পাকিস্তানের হাতে জে-৩৫, ভারতের উদ্বেগ বাড়ছে
চীন এখন এই জে-৩৫ যুদ্ধবিমান পাকিস্তানকে দিচ্ছে—এমন খবরে নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ চরমে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গত জুনে জানিয়েছেন, তারা ৪০টি জে-৩৫ ও কয়েকটি শানশি কে-৫০০ (এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম) পেতে যাচ্ছে। চীনের এই পদক্ষেপ ভারতের জন্য স্পষ্টতই উসকানিমূলক এবং ব্রিকসের অংশীদারিত্বের পরিপন্থী। তবে বেইজিং মনে করছে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা চীনের জন্য একটি সম্ভাব্য হুমকি—বিশেষ করে যদি তাইওয়ান ইস্যুতে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়।
ভারতের দ্বিমুখী যুদ্ধ (চীন ও পাকিস্তান) মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জনে ৪২টি স্কোয়াড্রনের প্রয়োজন বলে দেশটির বিমান বাহিনী বহুদিন ধরে বলে আসছে। অথচ বর্তমান সংখ্যাটি ২৯টিতে নেমে এসেছে।
ভারতের বিমান বহরে সংকট
গত এক দশকে ভারতের বিমান বাহিনীতে মাত্র ৩৬টি রাফালে ও ৩৬টি তেজস এমকে১ যুক্ত হয়েছে। তেজস এমকে১এ আরও উন্নত সংস্করণ হলেও তা আসছে বছরের শেষ দিকে পাওয়া যাবে। আর তেজস এমকে২ আসতে আসতে ২০৩০ দশক শুরু হয়ে যাবে।
তবে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগও রয়েছে—যেমন ৮৪টি সু-৩০এমকেআই বিমানের আধুনিকায়ন এবং নতুন ১২টি সু-৩০এমকেআই উৎপাদনের জন্য চুক্তি। তবে প্রোডাকশন লাইন ২০১৯ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেটি পুনরায় চালু করতে আরও ১৮ থেকে ২৪ মাস লাগবে।
ভারতের পঞ্চম প্রজন্মের বিমান: অনেকটা স্বপ্নের মতো
ভারতের নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রকল্প ‘অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফট (AMCA)’ এখনো অনেকটা প্রাথমিক পর্যায়ে। সরকার বলছে ২০৩২ সালে এটি চালু হবে, কিন্তু তেজস প্রকল্পের মতো বিলম্বিত ইতিহাস সামনে রেখে সেই সময়সীমাও অনিশ্চিত।
চীন যখন ষষ্ঠ প্রজন্মের প্রোটোটাইপ নিয়ে পরীক্ষামূলক উড়ান চালাচ্ছে, তখন ভারতের নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের বিমান প্রকল্প যেন এখনো রানওয়ের এক প্রান্তে পড়ে আছে।
পাকিস্তান-চীন যৌথ কৌশল: ভারতের জন্য সতর্কবার্তা
চীন ইতোমধ্যেই পাকিস্তানকে জে-১০সি দিয়েছে, এবং পাকিস্তানের নিজস্ব জেএফ-১৭ ব্লক ৩ তে রয়েছে চীনা AESA রাডার ও PL-15 মিসাইল। মে মাসের সংঘর্ষে পাকিস্তানের জে-১০সি বিমানে PL-15 মিসাইল ব্যবহার করে ভারতের কয়েকটি বিমান ভূপাতিত করার খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে এক বা একাধিক রাফালও থাকতে পারে।
তবে ভারতও প্রতিক্রিয়া দিয়েছে—পরবর্তী দিনগুলোতে ব্রহ্মোস মিসাইল দিয়ে পাকিস্তানে কার্যকরী আঘাত হানা হয় এবং আর কোনো ভারতীয় বিমান হারায়নি। এটি ভারতীয় পাইলটদের দক্ষতা এবং সাহসিকতার প্রমাণ।
ফিফথ-জেনারেশন জেট কেনা এখনো দূরের পথ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতকে এফ-৩৫ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও, সেটি বাস্তবে অগ্রসর হয়নি। প্রযুক্তিগত অসামঞ্জস্য, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর রাশিয়ান প্ল্যাটফর্ম নির্ভরতা এটি অসম্ভব করে তোলে।
এমনকি রাশিয়ার সু-৫৭ জেটও ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে—কারণ এটি এখনো পরীক্ষাধীন এবং ইউক্রেন যুদ্ধেও ভালো পারফর্ম করেনি।
বিকল্প পথ: MRFA প্রতিযোগিতা
পঞ্চম প্রজন্মের বিমান যখন অনিশ্চিত, তখন ভারতের সামনে সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প হলো MRFA (মাল্টি-রোল ফাইটার এয়ারক্রাফট) প্রকল্প। এতে অংশ নিচ্ছে রাফালে, এফ-১৫ইএক্স, ইউরোফাইটার টাইফুন, লোকহিড এফ-২১ (এফ-১৬ভি সংস্করণ), এবং গ্রিপেন ই/এফ।
এগুলি পঞ্চম প্রজন্মের না হলেও অত্যাধুনিক সেন্সর, ডেটালিংক এবং অস্ত্রসহ বহু উন্নত সুবিধা নিয়ে আসে। বিশেষ করে এগুলো দেশীয়ভাবে উৎপাদনের আগ্রহ দেখিয়েছে, যা ভারতের জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের সামনে একটি স্পষ্ট বাস্তবতা রয়েছে—যুদ্ধবিমান সংগ্রহে ধীর গতি ও অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত আজ দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে। অথচ চীন ও পাকিস্তানের আধুনিক ফাইটার এবং সমন্বিত যুদ্ধ কৌশল দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে ভারতের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে।
‘আমকা’ প্রকল্প ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারে, কিন্তু বর্তমান মোকাবেলায় ভারতের দরকার দ্রুত ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত—যা চীন-পাকিস্তানের যৌথ সামরিক শক্তির মোকাবেলায় কার্যকর হতে পারে।
ইউটি/টিএ