সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় (জুলাই) সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন না তোলা, সনদের অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধান কিংবা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার অঙ্গীকার করাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই দফা সংলাপে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ৮২ দফার সমন্বিত প্রস্তুত করা জুলাই সনদের খসড়া বাস্তবায়নের ৯ দফা অঙ্গীকারে বিধান রাখা হয়েছে।
বুধবার (১৩ জুলাই) সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছে পূর্ণাঙ্গ জুলাই সনদের খসড়া পাঠাবে কমিশন।
ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিগত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের জন্য প্রথম ধাপে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। পরে সেই ৬ কমিশনের সমন্বয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশনের প্রধান হিসেবে আছেন ড. ইউনূস। যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করবে। তার ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে।
সেই লক্ষ্যে গত মার্চ মাসে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে প্রথম ধাপে ১৬৬টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে ৬২টি প্রস্তাবে দলগুলো ঐকমত্য হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপের দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ২০টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। যার মধ্যে ৯টিতে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির নোট অব ডিসেন্ট আছে।
দলগুলোর ঐকমত্য হওয়া ৮২টি প্রস্তাব নিয়ে গত ২৮ জুলাই দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া দেওয়া হয়। খসড়ার ৭ দফায় ছিল পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সনদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো। এই প্রস্তাবে বিএনপিসহ তাদের সমমনা কয়েকটি দল সমর্থন করে। কিন্তু এতে আপত্তি জানায় জামায়াত, ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অধিকাংশ দল। তারা জুলাই সনদ বর্তমান সরকারের সময়ে বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি তোলে। না হলে জুলাই সনদের স্বাক্ষর না করার হুমকিও দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরিতে পুনরায় আলোচনার কথা জানায়।
গত ১০ এবং ১২ আগস্ট সংবিধান ও আইনজ্ঞদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ৯ দফা অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করে বলেও জানা গেছে কমিশন সূত্রে।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার দেশের একটি গণমাধ্যমকে বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং আইনি ভিত্তি কীভাবে দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব এসেছে। তবে, এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার অঙ্গীকারগুলো চূড়ান্ত হয়নি বলেও দাবি করেন বদিউল আলম।
বদিউল আলম জানান, আজ কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় (জুলাই) সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া কপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সমন্বিত খসড়ায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি উল্লেখ করার পাশাপাশি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াসহ দুই ধাপের সংলাপে সিদ্ধান্ত আসা ৮২টি বিষয় থাকবে। যেখানে কোনো-কোনো রাজনৈতিক দল কোনো প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে তা উল্লেখ থাকবে। একইসঙ্গে সনদ বাস্তবায়নের ৯ দফার অঙ্গীকারনামা থাকবে। যার ভিত্তিতে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো।
অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ ও বৈধতা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর এখতিয়ার আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকা এবং সনদকে সম্পূর্ণ আইনগতভাবে কার্যকর হিসেবে গণ্য করা, তার বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে আদালতেও প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে উল্লেখ রাখা হয়েছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তার পাশাপাশি সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা সংবিধান বা অন্যকোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা থাকছে অঙ্গীকারনামায়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সমন্বিত খসড়ায় অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বিবেচিত সুপারিশগুলো কালক্ষেপণ না করে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করা আছে।
সনদের অঙ্গীকারনামায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে হাজারও মানুষের জীবনদান, অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে জনআকাঙ্ক্ষার জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
জনগণের সার্বজনীন অভিপ্রায়ে তৈরি করা সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানের ৯৩ (২) অনুচ্ছেদ বা অন্য কোনো আইন বা রায় থাকা সত্ত্বেও কার্যকর ও প্রাধান্য লাভ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সম্বলিত অধ্যাদেশ জারি করার ওয়াদার বিষয়টিও রয়েছে।
জানা গেছে, জুলাই সনদে খসড়ায় দেশের শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের কথা রয়েছে।
অঙ্গীকারনামায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানকে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং গণঅভ্যুত্থানের সময়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দলগুলোর কাছে ওয়াদা নেওয়া হবে।
কমিশনের একজন সদস্য জানান, জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে গত ১০ আগস্ট ৬ জন বিশেষায়িত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বিশেষজ্ঞদের লিখিতভাবে তাদের পরামর্শ দিতে অনুরোধ করা হয়। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে তাদের সুপারিশ পাওয়ার পাওয়া যাবে আশা করি।
তিনি আরও বলেন, ওই সুপারিশ এবং জুলাই সদনের খসড়া নিয়ে ওই দিনই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা চিন্তা রয়েছে কমিশনের।
জুলাই সদনের বাস্তবায়ন এবং আইনি ভিত্তির বিধানগুলো নিয়ে তৃতীয় ধাপে কবে থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন বৈঠক করবে- জানতে চাইলে, বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই বিষয়ে এখন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কেএন/এসএন