বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে পুরোনো সমস্যা ফিরবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বুধবার সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিএনএ টিভি চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক লোকি সু।
সিএনএ : আপনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পার হয়েছে।
ওই সময় আপনার সামনে ৪ টি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। সেগুলো পূরণ করতে পেরেছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এটি কখনও সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এটাকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা।
নিজেরা স্থির করা লক্ষ্যগুলো অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছি। একটি লক্ষ্য ছিল সংস্কার। অনেক কিছু সংস্কারের প্রয়োজন। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ইত্যাদিসহ যেসব ব্যবস্থা পেয়েছি, তার সবই ছিল জালিয়াতির।
সবকিছুর ছিল অপব্যবহার এবং শোষণ, যাতে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার তৈরি হয়। ওই সরকার এই সুযোগ নিয়েছে। পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশের সমাজকে নষ্ট করেছে। যখন আমরা সরকারি দায়িত্ব নিলাম, তখন আমরা দেখেছি, রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের পর ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মতো পরিস্থিতি।
সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
সিএনএ : গণতান্ত্রিক সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেই কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবেন?
ড. ইউনূস : আমাদের অঙ্গীকার ছিল গণঅভ্যুত্থানের সময় জাতির প্রতি যে প্রতিশ্রুতি, তা নিশ্চিত করা। এগুলো তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে– সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন।
সিএনএ : আপনি কী ধরনের নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছেন?
ড. ইউনূস : একবার ভাবুন তো, যদি আমরা নির্বাচন দিয়ে শুরু করি তাহলে আমাদের সংস্কারের প্রয়োজন নেই, বিচারের প্রয়োজন নেই। কারণ, আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তাহলে সবকিছু নির্বাচিতদের হাতে চলে যাবে। কল্পনা করুন, অন্য দুটি কাজ না করে আপনার নির্বাচন হয়েছে। তারপর আপনি আবার সেই পুরোনো সমস্যায় ফিরে যাবেন।
সিএনএ : আপনি এটাকে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা বলছেন।
ড. ইউনূস : হ্যাঁ, অবশ্যই। কারণ, এটি কোনো আইনের শাসন তৈরি করে না।
সিএনএ : যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে গেলেন, তখন তাঁকে আপনি দানব বলেছেন।
ড. ইউনূস : যদি আরো শক্তিশালী কোনো শব্দ থাকত, তাহলে আমি সেটাই ব্যবহার করতাম। কারণ, তিনি রাস্তায় খুব কাছ থেকে মানুষ হত্যা করেছেন।
সিএনএ : আপনি চেয়েছিলেন ভারত যেন শেখ হাসিনার বার্তা প্রচার বন্ধ করে দেন...
ড. ইউনূস : বিচারই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তাঁকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির সুযোগ দেওয়া উচিত নয়।
সিএনএ : আপনি বলেছেন, বাংলাদেশের মানচিত্র না আঁকলে ভারতের মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। আপনার ভাষায়, দেশ দুটি গভীরভাবে একত্রিত।
ড. ইউনূস : অবশ্যই। আমি বহুবার বলেছি।
সিএনএ : চীন ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ কি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে?
ড. ইউনূস : অবশ্যই আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। পাকিস্তান, চীনও ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। আমরা কখনও বলিনি, আমরা ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই না। নেপাল এবং ভুটানকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে আনতে পারি। ভারতের সেভেন সিস্টার্স– সাতটি রাজ্যও এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে থাকতে পারে। কারণ, আমরা বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে একই সুবিধা ভাগ করে নিতে পারি।
সিএনএ : এখন পর্যন্ত আপনার আকাঙ্ক্ষার কি পরিবর্তন হয়েছে?
ড. ইউনূস : যখন আমাকে দায়িত্ব নিতে এবং সরকার গঠন করতে বলা হয়, তখন আমি বাংলাদেশ থেকে দূরে ছিলাম। আমি জানতাম কী ঘটছে।
ছাত্ররা আমাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ না বলেছি। তৃতীয় দিনে তারা আমার কাছে অনুনয় করে বলে, এত রক্তপাত হয়েছে, এত ত্যাগ স্বীকার করা হয়েছে, আপনি দেশ থেকে দূরে আছেন। নিজের জীবন উপভোগ করছেন। আপনাকে আমাদের দরকার, আর আপনি বলছেন না! তাদের এই কথা আমাকে নাড়া দিয়েছে। আমি বলি, ঠিক আছে, আমি রাজি।
এমআর