আজ প্রথম করোনার ভয় পেয়েছি। এ ভয় প্রাণে মরার নয়। ভাতে মরার। রাত দেড়টার দিকে অফিস থেকে ফেরার পথে কাওরান বাজারের সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে দেখি শত শত মানুষ। প্রায়ই এ পথে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরি। কখনো এমন ভিড় দেখিনি।
কথা বলে জানলাম, তাদের সবার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। কারো বগুড়া জেলায়। কারো জয়পুরহাটে। ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। উত্তরবঙ্গ থেকে যেসব ট্রাক কাওরানবাজারে শাকসবজি, মাছ এনেছে সেগুলোতে কম পয়সায় বাড়ি যেতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছেন। ঈদে এমন ঘরমুখো যাত্রীর উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। কিন্তু রোজার মাসখানেক আগে এমন ভিড় অভূতপূর্ব।
জয়পুরহাটের কালাইয়ের ফাহাদুল জানালেন, তিনি ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় ইজিবাইক চালান। করোনার ভয়ে গত বুধবার থেকে রাস্তাঘাট ফাঁকা, যাত্রী নেই। সারাদিনে যা ভাড়া পান, তাতে মালিকের জমার টাকা দিতেই টান পড়ে। খাওয়ার টাকা জোগাড় খুব মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছেন।
রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেন বগুড়ার শেরপুরের মোজাম্মেল। তিনি গত দু'দিন কাজ পাননি। কবে কাজ পাবেন নিশ্চয়তা নেই। ঢাকায় বসে খেয়ে জমানো টাকা নষ্ট করতে চান না। বাড়ি গিয়ে ধানের কাজ পাবেন, এ আশায় চলে যাচ্ছেন।
করোনা এখনও বাংলাদেশে খুব সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। এখনও 'লোকাল ট্রান্সমিশন' হয়নি বলে সরকারি ভাষ্য। কিন্তু এখনই যদি এমন কাজের সঙ্কট হয়, তাহলে ইউরোপের দেশগুলোর মতো মহামারী হলে কী অবস্থা হবে!
করোনা আতঙ্কে অনেকে সারাদেশে লকডাউন করার কথা বলছেন। কাজ ফেলে সবাইকে ঘরে থাকার কথা নসিহত দিচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমরা ইউরোপ না। কানাডাও না। আমরা বাংলাদেশ। লকডাউন আমাদের জন্য সমাধান নয়, বরং সমস্যা ভয়াবহ হবে।
অবশ্যি যেখানে করোনা সংক্রমণ হয়েছে সেখানে আঞ্চলিকভাবে গ্রাম, মহল্লাভিত্তিক লকডাউন হতে পারে। কিন্তু পুরো দেশে নয়। আমার ধারণা, এদেশে অর্ধেকের বেশি কর্মজীবী মানুষ দৈনিক মজুরিতে পেট চালান। অন্তত ৯০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ কায়িক শ্রম বিক্রি করে ভাত জোগাড় করেন। লকডাউন হলে কে তাদের ভাতের জোগান দেবে?
আমার নিজস্ব মতামত, করোনা প্রতিরোধের নামে কলকারখানা, গাড়িঘোড়া, কাজকর্ম বন্ধ করা হলে পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর। যত লোক করোনায় আক্রান্ত মরবে, তার বেশি মানুষ মরবে ক্ষুধায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বেসরকারি চাকরিজীবীরা স্রেফ বেকার হয়ে যাবে। ভাতের অভাবে পরতে হতে পারে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীও।
তাই লকডাউনের চিন্তা বাদ দিয়ে কীভাবে সবাই নিরাপদে কাজ করতে পারি, রুটি রুজি অব্যাহত রাখতে পারি, তার উপায় খুঁজতে হবে। আতঙ্কিত নয়, সচেতন হতে হবে। মিডিয়াকে শুধু ভয় নয়, আশা ও সাহসের কথাও শোনাতে হবে। গুজব প্রতিরোধের সহজ উপায় হচ্ছে, সত্য ও অবাধ তথ্য প্রবাহ থাকতে হবে।
সবশেষ কথা হলো, লকডাউন আমাদের জন্য বিলাসিতা। মৃত্যুর চেয়ে ক্ষুধা ভয়ঙ্কর।
লেখক: সাংবাদিক