সাময়িক বহিষ্কার ও কিছু কথা

সাময়িক বহিষ্কার! স্থায়ী বহিষ্কারের আগের ধাপও বলতে পারেন, আবার দায় এড়ানো শাস্তিও বলতে পারেন। কারণ সাময়িক বহিষ্কার স্থায়ী রুপ পেতে গেলে বহু ঝক্কি-ঝামেলা পার করতে হয়। এসব ঝক্কি-ঝামেলা নেতৃস্থানীয়রা নিতে চান না। আর তাই তো অনেক সাময়িক বহিষ্কৃত নেতা, ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী পার পেয়ে যান। আবার লঘু পাপে গুরু দন্ড দেয়ার নীল নঁকশা বাস্তবায়নের জন্যও সাময়িক বহিষ্কারের জুড়ি নেই। আটঘাট বেঁধে যদি কেউ কারো পেছনে লাগে তবে ‘সাময়িক বহিষ্কার’-এর অনেক শক্তি।

যাইহোক, মুল কথায় আসা যাক। আমরা প্রায়ই দেখি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে অথবা অছাত্র সুলভ কর্মকান্ডের জন্য সাময়িক বহিষ্কারের নামে সাময়িক শাস্তি প্রয়োগ করা হয়। শিক্ষকদের কর্মকান্ডের জন্যও একই শাস্তির নজির আছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তা হারিয়ে যায় নতুন কোনো ইস্যূর ভিড়ে অথবা গোপন তদবিরে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী সাময়িক বহিষ্কারের শিকার হলে তার কি ফেরার সুযোগ থাকে? থাকে হয়তো মুচলেকা দিয়ে নয়তো গোপন তদবিরের জোরে।

প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা গোপন তদবির অথবা মুচলেকা পেয়ে বুক চিতিয়ে চলেন। তারা মনে করেন, বাদড়টাকে শেষমেষ শায়েস্তা করা গেল। কিন্তু আদৌ কি ওই শিক্ষার্থীকে তার ভুল পথ থেকে ফেরানো গেল? ভেবে দেখেছেন কি?

একজন শিক্ষার্থীর ভাষার ব্যবহার ও সমালোচনাধর্মী লেখালেখিতে বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় একটি আইনগত ব্যক্তি। কাজেই তার মান সম্মান আছে। আছে আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখার অধিকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থী যদি ভুল পথে চলে, তবে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনারও তো নিজস্ব একটি নিয়ম নির্দেশিকা আছে। তো ভুল করা শিক্ষার্থীর ওপর সেসব নির্দেশিকা প্রয়োগ করা হয় তো? নাকি ঠুসঠাস সাময়িক বরখাস্ত?

এক বা একাধিক শিক্ষার্থীর কর্মকাণ্ডে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কি করার থাকে? হুটহাট বহিস্কারাদেশ দিলেই কি সমাধান? তড়িঘড়ি করে বহিস্কার করার মধ্যে অবশ্য সুবিধা আছে। তাহল- বিক্ষুব্ধ পক্ষকে খুব সহজে অল্প সময়েই শান্ত করা যায়। আবার এর একটি অসুবিধাও রয়েছে। যেমন- ভুলের মধ্যে চলতে থাকা শিক্ষার্থী কিছুদিন হয়তো সাময়িক বহিষ্কৃত হয়ে চুপচাপ থাকবে, কিন্তু সে কি ভুল থেকে বের হতে পারবে? আসলে তড়িৎ কোনো কিছুর ফলই ভালো নয়।

আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-বিষয়ক উপদেষ্টার কাজ কি? কর্তৃপক্ষের আয়োজিত বড় বড় সভা ও প্রশাসনিক সভায় বসে শুধু চা সিঙ্গাড়া খাওয়া? একদমই না। ছাত্র-উপদেষ্টার অনেক কাজ। কিন্তু তাদেরকে সেই কাজগুলো করতে দেয়া হয়? আমার মনে হয়, ছাত্র-উপদেষ্টাদের নিজের মত করে কাজ করতে দেয়া হয় না। পদবন্টনের জন্যই একজনকে এই পদ দিয়ে শান্ত রাখা শুধু। কাজের কাজ যা করেন, তা ওই ‘সাময়িক বরখাস্ত’।

ছাত্র উপদেষ্টা কি ভুলের মধ্যে চলা শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন? প্রতিষ্ঠানপ্রধান কি এ বিষয়ে ছাত্র উপদেষ্টাকে কাজ করার যথাযথ ও যৌক্তিক নির্দেশনা দেন? ছাত্র-উপদেষ্টার প্রচেষ্টার পরেও যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার মত কাজ করতেই থাকে, তখন তাকে শাস্তির মুখোমুখি করা সমীচীন নয় কি? আমরা এসব না করে নামকাওয়াস্তে বহিষ্কারাদেশ দিয়ে দায় এড়িয়ে যায়। দুদিন পরে আবারও ‘যেই লাউ সেই কদু’।

এখন ভাবুন, ‘সাময়িক বহিষ্কার’ কি শুধু শিক্ষার্থীদের ওপরই প্রযোজ্য? কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজ কর্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কি কখনোই ক্ষুণ্ণ হয় না? যদি হয়েই থাকে তবে তাদের শেষ পরিণতি কি? এই যে অতীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লাখ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। সেসব খবর নিয়ে কোর্ট কাছারি পর্যন্ত হয়েছে। তদন্ত কমিটির পরে তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু অবৈধ অর্থ লেনদেনকারীদের কি কোন শাস্তি হয়েছে? তাদের ওপর আরোপিত সাময়িক বহিষ্কারাদেশ কি স্থায়ী বহিষ্কারে পরিণত হয়েছে? হয়নি। যদি হয়েও থাকে, তার মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও রেশারেশিই ছিল বেশি। এসব ঘটনা দেখে আমরা এখন ভাবতেই পারি, এরা চোরে চোরে যদি মাসতুতো ভাই না, এরা তো চোরে চোরে ওস্তাদ সাগরেদ। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বলি, এসব অপরাধীদের বিচার করুন। নাকি ঘুষ লেনদেনে ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পায়। তাদের বিচারটা করুন, জাতি জানুক আপনারা কতটা ক্ষমতা ধর। নাকি কাক বলে কাকের মাংশ খেতে নেই?

সর্বশেষ বলতে চাই, সাময়িক বহিষ্কারের এই খোড়া শাস্তির প্রথা বাদ দিয়ে ভুল পথে চলা শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করুন। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো এরকমই হয়। পুরস্কার ও তিরস্কারের সিস্টেমকে বুনো ও পঁচা বানিয়ে রেখে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আবারও বলছি, পথভ্রষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্রনেতাদের কাউন্সিলিং করুন। যে কোন বিষয় নিয়ে সমালোচনা করার পরিধি তাদের জানিয়ে দিন। দেখবেন, মাসে মাসে দুই চারটা সাময়িক বরখাস্তের ফর্দ নোটিশ বোর্ডে আর লটকাতে হবে না। তখন সবার গলায় গলায় ভাব জমবে। যৌক্তিক ও রুচিশীল সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা সৃষ্টি করুন। তা না হলে, ঘোর বিপদ!

লেখক: সাংবাদিক

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সাভারে বাসে আগুন, লাফ দিয়ে প্রাণ রক্ষা চালকের Nov 16, 2025
img
বিমানবন্দর রেলস্টেশনে এবার ককটেল বিস্ফোরণ Nov 16, 2025
img
তিনবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করলেন মেসির সতীর্থ Nov 16, 2025
img
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির মামলার রায় সোমবার Nov 16, 2025
img
রিয়াল মাদ্রিদকে বড় ব্যবধানে উড়িয়ে দিল বার্সেলোনা Nov 16, 2025
img

অনূর্ধ্ব ১৭ ফিফা বিশ্বকাপ

জার্মানির বিদায়, বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় নর্থ কোরিয়া-অস্ট্রিয়া Nov 16, 2025
img
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো মূল্যবোধ : মিঠুন চক্রবর্তী Nov 16, 2025
img
পিকচার আভি বাকি হ্যায়, বার্তা বলিউড তারকার Nov 16, 2025
img
ঢাকায় এসে পৌঁছেছে ভারতীয় ফুটবল দল Nov 16, 2025
img
আসলে শেখ হাসিনা আমার মায়ের মতো : বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী Nov 16, 2025
img
ছেলের সঙ্গে বাবার দূরত্বের কারণ খুঁজলেন সোহিনী Nov 16, 2025
img
সাবেক চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগের দুই নেতা গ্রেপ্তার Nov 16, 2025
img
সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চুপ থাকা প্রয়োজন : অক্ষয় কুমার Nov 16, 2025
img
পরিবারই সত্যিকারের বন্ধু, মন্তব্য অভিনেত্রীর Nov 16, 2025
img
রাজধানীর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধে বাসে আগুন Nov 16, 2025
img
মা হওয়াই নারীর পূর্ণতা নয় : শাবানা আজমি Nov 16, 2025
img
দুর্নীতিতে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলকে জনগণ আর ভোট দেবে না: তাহের Nov 16, 2025
img
সেনেগালের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের জয়, গোল করলেন এস্তেভাও-ক্যাসেমিরো Nov 16, 2025
img
পুলিশের মনোবল আগের চেয়ে বেড়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
জানা গেল ২০২৬ সালের রোজা ও ঈদুল ফিতরের সম্ভাব্য তারিখ Nov 16, 2025