রোয়াইলবাড়ি: একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র

প্রাচীন বাংলার রাজা-বাদশারা কখনও নিজের বিলাসিতার জন্য, কখনও যুদ্ধের প্রয়োজনে আবার কখনও শখের বশবর্তী হয়ে নির্মাণ করেছেন কতোইনা দর্শনীয় স্থাপনা! তেমনি বাংলার সুলতানি আমলের একটি নিদর্শন নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি দুর্গ।

দুর্গটির নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, আরবি শব্দ রেইল বা রালাহ এবং বাংলা শব্দ বাড়ি নিয়ে রোয়াইলবাড়ি। রেইল বা রালাহ অর্থ মানুষ বা ঘোড়ার অগ্রবর্তী দল বা অশ্বারোহী সৈন্যদল। আর বাড়ি শব্দের অর্থ ঘর বা বাসস্থান। সুতরাং রোয়াইলবাড়ি বলতে বোঝায় সৈন্যদলের বাসস্থান।

বর্তমানে কেন্দুয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন রোয়াইলবাড়ি। এটি কোটবাড়ি দুর্গ নামেও পরিচিত। উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রামটি অবস্থিত। নান্দাইল চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১৮ কিমি দক্ষিণ পূর্বে নান্দাইল-কেন্দুয়া সড়কের উপর অবস্থিত সাহিতপুর বাজার। সাহিতপুর বাজার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এবং আঠারবাড়ি রেলস্টেশন থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে রোয়াইলবাড়ি দুর্গ অবস্থিত। রোয়াইলবাড়ি দুর্গের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেতাই নদী।

দুর্গটি কে বা কারা নির্মাণ করেছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা বা প্রমাণ নেই। দুর্গটির নির্মাণ শৈলীতে সুলতানি আমলের স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। তাই অনেক গবেষক এটাকে সুলতানি আমলের স্থাপত্য বলেই মনে করেন। আবার কোনো কোনো গবেষক এটাকে মোগল আমলের স্থাপত্য বলেও ধারণা করেছেন।

দুর্গটি সম্পর্কে প্রচলিত আছে, ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ কামরূপের রাজা নিলাম্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে কামরূপ দখল করেন নেন। পরে হুসেন শাহ’র পুত্র নছরত শাহ সেখানকার শাসনভার গ্রহণ করেন। কিন্ত কিছুদিনেই মধ্যেই রাজা নিলাম্বর পাল্টা হামলা চালিয়ে পুনরায় কামরূপ দখল করে নেয়। নিরুপায় হয়ে নছরত শাহ পালিয়ে রোয়াইলবাড়িতে এসে আশ্রয় নেন।

নছরত শাহর পরে আকবর শাহ এখানে শাসন করেন। পরে মসনদে আলী ঈশা খাঁ এখানে সাম্রাজ বিস্তার করেন। ঈশা খাঁর মৃত্যু হলে তারই পরিষদের দেওয়ান জালাল রোয়াইলবাড়ির আধিপত্য গ্রহণ করেন। জালাল ক্ষমতা পেয়ে দুর্গটি সংস্কার ও দুর্গের বহিরাঙ্গনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা জালাল মসজিদ নামে পরিচিত।

দুই যুগ আগেও দুর্গটির বেশিরভাগ অংশ ছিল মাটির নিচে অদৃশ্য। ১৯৮৭ সালে সরকার দুর্গটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেয়। তারপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দুর্গে খনন করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। বিভিন্ন সময় খনন করে এখান থেকে উদ্ধার করা হয় বহুকক্ষবিশিষ্ট একাধিক ইমারতের চিহ্ন, সানবাঁধানো ঘাটসহ দুটি বড় পুকুর, মূল প্রবেশদ্বার, ইটের দেয়ালবেষ্টিত দুর্গ, দুটি পরিখা, বুরুজ ঢিবি বা উঁচু ইমারত, বারদুয়ারী ঢিবি, মিহরাব, চওড়া প্রাচীর, কবরস্থান, মসজিদ, লতাপাতা ও ফুলে-ফলে আঁকা রঙিন প্রলেপযুক্ত কারুকাজ, পোড়ামাটির অলত ইট, টালি, টেরাকোটা, বর্শা, প্রস্তরখণ্ড এবং লোহা ও চিনামাটির তৈরি নানা ধরনের জিনিসপত্র।

প্রায় দুই যুগ পর ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে আবারো খনন কাজ হয় দুর্গটিতে। খননে খোঁজ মিলেছে দুর্গের মূল ফটক বা প্রবেশদ্বার।

দুর্গটি প্রায় ৪৬ একর ভূমি নিয়ে গড়ে উঠেছিল। যার মোট আয়তন প্রায় ৫৩৩ X ৪২৬ মিটার।
দুর্গ এলাকাটি তিন ভাগে বিভক্ত। মূল দুর্গের পূর্বদিকের ইটের দেয়ালে রয়েছে সিংহদ্বার। পুকুর দুটি রয়েছে দুর্গের সামনের অংশের পূর্বদিকে। সিংহ দরজা বরাবর একটি উঁচু রাস্তা দ্বারা পুকুর দুটি বিচ্ছিন্ন করা ছিল। দক্ষিণ দিকের মাটির দেয়ালের দু’পাশে দুটি পরিখা। বেতাই নদী থেকে আসা নৌযানসমূহ নোঙ্গর করতে দক্ষিণ দিকের পরিখাটি ব্যবহার করতো বলে ধারণা করা হয়।

দুর্গের স্থাপনাগুলো সুলতানি আমলের স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হলেও এর কারুকাজ ছিল অনেক বেশি নান্দনিক ও শিল্পসমৃদ্ধ বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ব গবেষকরা। বেতাই নদীর পাড়ে দুর্গ এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি বাজার। আর দুর্গের পাশেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি মাদরাসা।

দুর্গ এলাকাটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ হলেও, এর রক্ষণাবেক্ষণে চারপাশে কোনো সীমানা চিহ্নিত করা নেই। তাই অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে দুর্গটি। আবার অনেকেই অবৈধভাবে দখল করে ব্যবহার করছে দুর্গের বিভিন্ন প্রান্ত।

ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি এক পলক দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে দুর্গটিতে। জেলা পরিষদের উদ্যোগে দুটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঐতিহাসিক এই স্থানটি দেশের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হয়ে উঠতে পারে।

যেভাবে যাবেন: প্রথমে ঢাকা হতে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণায় যেতে হবে বাস বা ট্রেনে করে। সেখান থেকে বাস বা সিএনজি যোগে কেন্দুয়ায়। অথবা সরাসরি বাসযোগে কেন্দুয়ায়। কেন্দুয়া পৌরসভা থেকে সিএনজি বা ছোট যানবাহনে সাহিতপুর বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে অটোরিকশা বা ছোট যানবাহন দিয়ে সরাসরি রোয়াইলবাড়ি বাজারে যাওয়া যায়। আর বাজার থেকে সহজেই রিকশায় বা পায়ে হেটে যাওয়া যায় দুর্গে।

কোথায় থাকবেন: থাকার জন্য কেন্দুয়ায় পাবেন আবাসিক হোটেল। তবে এগুলো তেমন মানসম্মত নয়। নেত্রকোনা বা কিশোরগঞ্জে থাকা যাবে। তবে একটু ভালো মানের হোটেলে থাকতে চাইলে ময়মনসিংহে থাকতে পারেন।

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রেজাল্ট বাজে হয়েছে বা ফেল করেছেন বলে মন খারাপ করবেন না: খায়রুল বাসার Jul 10, 2025
img
টস হেরে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ, দলে ফিরলেন নাঈম-সাইফউদ্দিন Jul 10, 2025
img
সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য লুকালে মার্কিন ভিসা বাতিলের ঝুঁকি Jul 10, 2025
img
আমরা এখনও ঘনিষ্ঠ হই, আমিরের প্রাক্তন কিরণ Jul 10, 2025
img
চিত্রনায়িকা পপির চাচাকে নিজ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ Jul 10, 2025
img
বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন সাবেক গভর্নরসহ ৯ শীর্ষ কর্তাদের নথি তলব Jul 10, 2025
img
রাজধানী ঢাকাসহ ১২ জেলায় হতে পারে ঝড় Jul 10, 2025
img
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত দুই বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো: আলী রীয়াজ Jul 10, 2025
img
পলিথিন বন্ধে শুরু হচ্ছে যৌথ বাহিনীর অভিযান : পরিবেশ উপদেষ্টা Jul 10, 2025
img
পুরো আসনের ভোটের ফল স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা ফেরত চাইল ইসি Jul 10, 2025
img
নির্বাচনের কারণে পেছাতে পারে এবারের বিপিএল Jul 10, 2025
img
এস আলম পরিবারের সিঙ্গাপুরের ব্যাংক হিসাব-শেয়ার ফ্রিজ Jul 10, 2025
img
চ্যালেঞ্জের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে গিয়েছি : আসিফ আকবর Jul 10, 2025
img
শাজাহান খানের মেয়ের সম্পদের বিবরণী চাইল দুদক Jul 10, 2025
শাপলা-দোয়েল বাদ, তালিকায় থাকল যেসব প্রতীক Jul 10, 2025
নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে মা-বাবার বিরুদ্ধেই মামলা! কী বলছে আইন? Jul 10, 2025
img
জওয়ানের চরিত্রে অভিনয়ের আগে কঠিন প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সালমান খান Jul 10, 2025
মা-বাবার বিরুদ্ধে মেহরীনের মামলা: ভেঙে পড়ছে কি পারিবারিক বন্ধন? Jul 10, 2025
img
রাজনীতিতে নতুন লক্ষ্য কি প্রধানমন্ত্রী হওয়া? জবাব দিলেন কঙ্গনা Jul 10, 2025
পরশুরামে পানি কমলেও প্লাবিত হচ্ছে ফেনি শহর Jul 10, 2025