বাংলা লোকসঙ্গীতের আকাশ আজ আরও নিঃসঙ্গ। লালনগানের রানী ফরিদা পারভীন চলে গেছেন, রেখে গেছেন বেদনার দীর্ঘ রেশ আর অমর সব সুর।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিডনির জটিলতায় দীর্ঘদিন ভুগছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার ভেতরে ছিল সংগীতের প্রতি অগাধ টান, এক অদম্য নিবেদন।
নাটোরে জন্ম, কুষ্টিয়ার মাটিতে বেড়ে ওঠা-সেখানেই লালন গানের সঙ্গে তার আত্মিক মেলবন্ধন। নজরুলসংগীত দিয়ে পথচলা শুরু করলেও লালনের সুরই হয়ে ওঠে তার জীবনের স্থায়ী ঠিকানা। কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি লালনকে পৌঁছে দিয়েছিলেন ঘরে ঘরে, শহরে গ্রামে, দেশ-বিদেশে। তাই সংগীতপ্রেমীরা তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘লালনগানের রানী’।
তার গাওয়া বহু গান শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে অমূল্য ধন হয়ে। “এই পদ্মা এই মেঘনা, এই যমুনা গঙ্গা” শুধু নদীর নাম উচ্চারণ নয়, বরং বাংলার মাটির টানকে অমর সুরে গেঁথে দিয়েছে। “নিন্দার কাঁটা জুড়ি” গানটি মানুষের সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। আবার “তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম” পরিবেশনায় তিনি তুলে ধরেছেন এক গভীর বেদনা, যা যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে।
এছাড়া “মন রে, কৃষিকাজ জানো না”, “সত্য বল সুপথে চল”, “আমার গুরুবিহীন রাতে ঘুম আসে না”, “অপরের ঘরে ধান ফলবে, আমার ঘরে চাষ নাই”-এসব গান তার কণ্ঠে হয়ে উঠেছিল জীবন্ত দর্শন। লালনের ভাবধারা যে কেবল দর্শনের বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তা কেমন করে বাজে, তার বাস্তব উদাহরণ ছিলেন ফরিদা পারভীন।
ফরিদা পারভীন শুধু গায়কী নয়, লালনের দর্শনকেও বহন করতেন হৃদয়ে। তার পরিবেশনা ছিল স্রেফ গান নয়, বরং আত্মিক আর দার্শনিক সংলাপের মতো। শ্রোতারা অনুভব করতেন, লালনের সুর যেন নতুন করে তাদের ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে।
১৯৮৭ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০০৮ সালে ফুকুওকা এশিয়ান কালচার অ্যাওয়ার্ড-পুরস্কারের তালিকা দীর্ঘ হলেও তিনি নিজে ছিলেন নিভৃতচারী। বলতেন, “সঙ্গীত আমার ধ্যান, পুরস্কার নয়।” এই নিরাসক্তি তাকে আরও অনন্য করে তুলেছিল।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন গীতিকার ও সুরকার আবু জাফরের জীবনসঙ্গিনী। আবু জাফর চলে যাওয়ার পর তিনি ভীষণ একা হয়ে পড়েছিলেন। সেই শূন্যতাকে তিনি ভরাট করেছিলেন সুরের ভুবনে, শ্রোতাদের ভালোবাসায়।
আজ তিনি নেই, কিন্তু থেকে গেছে তার গানের ভাণ্ডার, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ছুঁয়ে যাবে। ফরিদা পারভীন প্রমাণ করে গেছেন-একজন শিল্পীর মৃত্যুই কেবল মৃত্যু, তার সৃষ্টির মৃত্যু হয় না।
লালন গানের রানী হয়তো থেমে গেছেন, কিন্তু তার কণ্ঠে বাজতে থাকা সুর চিরকালীন হয়ে থাকবে। বাংলার লোকসঙ্গীত তাকে মনে রাখবে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অনন্ত আবেশে।
টিকে/