বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দিল্লিতে আলোচনা সভা

‘বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতি আমাদের মানতে হবে, বুঝতে হবে’

হঠাৎ (পালাবদল) হয়ে যাওয়াতে (দিল্লির) একটা শকের মতো হয়ে গিয়েছিল… এখন মেনে নিতে হবে যে, বাংলাদেশের ভোটাররা যাকেই তাদের শাসক হিসেবে চিহ্নিত করবে তাদের আমাদের মানতে হবে।

বাংলাদেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিবিসিকে কথাগুলো বলেছেন ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় আমলা ও প্রসার ভারতী বোর্ডের প্রাক্তন সিইও জহর সরকার বিশ্বাস। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতি আমাদের মানতে হবে, বুঝতে হবে। বোঝার থেকেও বেশি কথা হলো মানতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো প্ররোচনায় পা না দিয়ে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের নির্বাচনে কী ফলাফল হয়, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করা।

বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ভারতের বৈদেশিক নানা ইস্যুতে চর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার (আইআইসি)। ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারতের দিক থেকে কী ধরনের প্রস্তুতি কাঙ্ক্ষিত, সেই প্রশ্নকে ঘিরেই বিশ্লেষকরা সেখানে নানা সম্ভাবনা নিয়েই আলোচনা করেছেন। কিবে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয় সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনটিতে।

বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন না হয়— এমন প্রশ্নের জবাবে জহর সরকার বলেন, এটা ঠিকই, এর মধ্যে একটা পয়েন্ট অব ভিউ এসে যায়, সেই সরকার যদি আমাদের বিরুদ্ধে হয় তখন কী হবে? আরে এসব কথা পরের কথা… এগুলো পরের কথা… কে আসবে কে যাবে, কেউ জানে না। আসলে হচ্ছে কী, (বাংলাদেশে) কিছু ক্ষ্যাপা লোক টুকটাক করে কিছু বলে ফেলছে, যার বেসিসে সঙ্গে সঙ্গে একটা রিঅ্যাকশন হচ্ছে, তাতে মানুষ ক্ষেপে যাচ্ছে।

‘আসলে মনে রাখতে হবে (বাংলাদেশে) এখনকার যে সরকার সেটা একটা কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট, তাদের এত বেশি বলার বা খোঁচানোরও প্রয়োজনীয়তা নেই, তারা তো ইলেকশনটা করে নিলেই পারে।’

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাও ছিলেন এই আলোচনা সভায়। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যদি ভুল একটা সরকার সত্যিই ক্ষমতায় এসে যায়, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থর জন্য তার পরিণতি কী হতে পারে সেটা ভেবেও আমি কিন্তু সত্যিই দ্বিধান্বিত। আসলে এটার একটা বাস্তবতার দিক আছে, নিরাপত্তার দিক আছে, যেটা ভারতের সব নাগরিকের জন্যই দুশ্চিন্তার বিষয়।

‘এটা খুব সহজে বলাই যায়, যে কেউই জিতে ক্ষমতায় আসুক আমরা তাদের সঙ্গেই কাজ করবো, কিন্তু সেই যে কেউটা যদি আপনার স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে তাহলে তো সেটা নিয়ে আপনাকে অবহিত থাকতে হবে। তখন তো আপনি বলতে পারেন না, ও আপনারা ওখানে ক্ষমতায় আছেন, বেশ বেশ।’

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আরও মনে করেন— দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী যারা, তাদের দেশের পরিস্থিতিকে তাদের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে ভারত কখনোই এড়িয়ে যেতে পারে না। মানে যেখানে ভারতের স্বার্থ জড়িত, সেটা অবশ্যই ভারতেরও ব্যাপার।

তিনি বলেন, যদিও আমি আগেই বলেছি আমরা আমাদের সব প্রতিবেশীর সঙ্গেই সহযোগিতার স্পিরিট নিয়ে কাজ করতে চাই, আর আমাদের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতিরও মূল কথা সেটাই, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে আমরা একটা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। আমাদের নিরাপত্তা স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয় সেটা আমাদের দেখতেই হবে। আর আমাদের ইমিডিয়েট নেইবারহুডের কথা যদি বলি, যেসব দেশের সাথে আমাদের অভিন্ন সীমান্ত আছে, সেখানে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে কিছু থাকতে পারে না!

আলোচনা সভায় অংশ নেওয়া আরেকজন হলেন ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ও দীর্ঘদিনের বাংলাদেশ গবেষক শ্রীরাধা দত্ত। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সম্প্রতি তিনি ঢাকা সফর করেছেন এবং জামায়াত, বিএনপি, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখাও করেছেন।

সেই সব আলোচনার প্রেক্ষাপটে তিনি মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে অন্তত আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না। আর ভারতেরও সেই বাস্তবতাটা স্বীকার করে নেওয়া উচিত।

২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪-এ কেন আমরা ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা বলিনি? এখন কেন বলছি আমরা? এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।

বস্তুত গত তিনটি নির্বাচনে ভোট কারচুপি অথবা বিএনপির বাইরে থাকাকে ভারত যেভাবে চোখ বন্ধ করে ‘অনুমোদন’ দিয়েছিল, সেটাই তাদের নৈতিক অবস্থানকে এখন দুর্বল করে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

‘সুতরাং আমার মনে হয় বাংলাদেশকে এখন আমাদের বলা উচিত ওরা যেটা নিজেরা ঠিক করবে, আমরা সেটাই অ্যাকসেপ্ট করবো। তা আমাদের পছন্দ হয়তো নাও হতে পারে, হয়তো হবে না। কিন্তু ওদের যেটা পয়েন্ট অব ভিউ, মানে ওরা যেটা চায়, মেজরিটি যেটা চায় তার একটা মর্যাদা দিতে হবে।’

বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতের যে শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে সেই লক্ষণ স্পষ্ট, বিভিন্ন পাবলিক ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংসদের নির্বাচনেও তারা দাপুটে জয় পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দিল্লিতেও কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করছেন, জামায়াত এখন সে দেশে সম্পূর্ণ নতুন চেহারার একটি দল, কার্যত তারা যেন জামায়াত ২.০!

সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের সঙ্গে বৈঠকের সূত্র ধরে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, আমি ডা. তাহেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ধরুন আপনারা সরকার গড়ার মতো সংখ্যা পেয়ে গেলেন, তাহলে কি দেশে শরিয়া আইন আনতে চাইবেন? উনি তখন বললেন, এটা আবার কোথায় শুনলেন? আমরা কবে কোথায় বলেছি জিতলে আমরা বাংলাদেশে শরিয়া আইন আনবো।

‘আমি ১৯৭১র কথাও জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারণ বহুকাল ধরেই আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা কী ছিল। তিনি তখন বললেন, মতিউর রহমান নিজামি বা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো নেতারা কিন্তু প্রকাশ্যেই একাত্তরে জামায়াতের অবস্থানের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন! আমরা ওটা স্বীকার করেছি।’

ফলে জামায়াতকে নিয়ে শ্রীরাধা দত্তের উপসংহার, ওরা আসলে দারুণ ‘চার্ম অফেনসিভ’, কথায় আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে। কিন্তু আসলে ওরা বাস্তবে কী করছে সেটা অবশ্য অন্য গল্প! আর ভারতকেও সেটা বুঝেই পা ফেলতে হবে।

তবে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলছেন, জামায়াত হলো আসলে মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ। এরা সেই একই মুসলিম ব্রাদারহুড, যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশরসহ পৃথিবীর নানা দেশেই আছে। যেমনটা বলে না, চিতাবাঘ আসলে কখনোই তাদের গায়ের ডোরা বদলায় না। এখানেও বক্তারা অনেকেই নিশ্চয়ই একমত হবেন। জামায়াতও আসলে কখনোই পাল্টাবে না।

সূত্র: বিবিসি বাংলা। 

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ডিএসইতে প্রথম ঘণ্টায় লেনদেন ১৫০ কোটি টাকা Sep 18, 2025
img
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইইউ প্রতিনিধি দলের সন্তোষ প্রকাশ Sep 18, 2025
img
সম্মেলনের আগে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ ফজলুর রহমানের Sep 18, 2025
img
‘বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানকে পাকাপোক্ত করতে হবে’ Sep 18, 2025
img
পাইক্রফটকে ‘ভারতের প্রিয় ম্যাচ রেফারি’ বললেন রমিজ রাজা Sep 18, 2025
img
পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি Sep 18, 2025
img
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাক : ঐশী Sep 18, 2025
img
প্রতিটি ভোটারের আস্থা নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব : তারেক রহমান Sep 18, 2025
img
দ্বিতীয় দিনের মতো ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিচ্ছেন নাহিদ Sep 18, 2025
img
বাংলাদেশে সবচাইতে আগে জরুরি জাতীয় নির্বাচন : জিল্লুর রহমান Sep 18, 2025
img
মেটা উন্মুক্ত করলো নতুন ডিসপ্লে স্মার্ট গ্লাস Sep 18, 2025
img
গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল: বার্নি স্যান্ডার্স Sep 18, 2025
img
ঢাকায় আজ বিক্ষোভ করবে জামায়াতসহ ৭ দল Sep 18, 2025
img
জয়পুরহাটে ছাত্রদলের সম্মেলন ব্যর্থ, ৭ নেতাকে বহিষ্কার Sep 18, 2025
img
তোমার অভাব প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করি: অপু বিশ্বাস Sep 18, 2025
img
আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড Sep 18, 2025
img
সমুদ্রে পাওয়া গেল ৮ ধরনের ভারী খনিজ Sep 18, 2025
img
‘ডাইরেক্ট থ্রোতে’ মাথায় বল লেগে মাঠের বাইরে আম্পায়ার Sep 18, 2025
img

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দিল্লিতে আলোচনা সভা

‘বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতি আমাদের মানতে হবে, বুঝতে হবে’ Sep 18, 2025
img
ঢাবির পরিবহনে ডিজিটাল রূপান্তর, চালু হচ্ছে বাস ট্র্যাকিং অ্যাপ Sep 18, 2025