সৌদির নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রধান সঙ্গী এখন পাকিস্তান

পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে পাকিস্তান ও সৌদি আরব। দুই দেশের নতুন এই প্রতিরক্ষা চুক্তিকে উপসাগরীয় নিরাপত্তার মোড় ঘোরানো পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, এই জোট কেবল দুই দেশের সম্পর্ককে গভীর করবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে নতুন বাস্তবতা তৈরি করবে। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল।

বিশ্লেষকদের মতে, বুধবার পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তি উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার মানচিত্র পাল্টে দেবে। এতে স্পষ্ট হচ্ছে- আরব দেশগুলোর আস্থায় পরিবর্তন এসেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর নির্ভরশীলতা কমছে।

বুধবার রাতে রিয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স এগ্রিমেন্টে সই করেন। এর ধারায় বলা হয়েছে, এক দেশের ওপর আক্রমণ মানে অন্য দেশের ওপরও আক্রমণ। দীর্ঘদিনের এই দুই মিত্র দেশের মধ্যে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক উজাইর ইউনুস বলেন, এ চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান বহু বছর ধরে আরব উপদ্বীপের প্রধান নিরাপত্তা রক্ষক হিসেবে অবস্থান করবে। তিনি মনে করেন, কাতারের দোহায় সাম্প্রতিক হামলাগুলোই নিরাপত্তা চাহিদায় দ্রুত পরিবর্তন এনে এ উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করেছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক তৌকির হুসেইন বলেন, এটি আসলে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা দীর্ঘ কৌশলগত অংশীদারত্বের পুনঃনিশ্চয়ন। তার মতে, চুক্তির সময়টাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যা দোহা সম্মেলনের পরপরই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, উপসাগরীয় দেশগুলো কেবল বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং বাস্তব পদক্ষেপ নিচ্ছে।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নতুন অংশীদারত্ব খোঁজার এই সূচনা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার ও ইরানের সঙ্গে টানাপোড়েন কমাতেও ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর নিরাপত্তার প্রতি আরব দেশগুলোর আস্থা অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

অভিজ্ঞ কূটনীতিক জাভেদ হুসেইন ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। নতুন এই চুক্তি তাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করবে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সেই ধারা, যেখানে এক দেশের ওপর আক্রমণ মানে অপর দেশের ওপরও আক্রমণ যা ভারত বা ইসরায়েলের মতো দেশগুলোকে স্পষ্ট বার্তা দেবে।

লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ড. রাবিয়া আখতার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, এ চুক্তি দীর্ঘদিনের অনানুষ্ঠানিক সামরিক সহযোগিতাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। তবে পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার দিক থেকে এটি কোনো নীতিগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি পরোক্ষ আশ্বাস। তার মতে, পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরবকে তার পারমাণবিক ছাতার নিচে আনবে না, তবে এ নিয়ে ধোঁয়াশাই সৌদি স্বার্থে কাজ করবে।

সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সৈয়দ তালাত হুসেইন বলছেন, বিপুল সম্পদ ও শক্তিশালী সামরিক দক্ষতা মিলিত হয়ে এ চুক্তিকে ‘গেম-চেঞ্জার’ বানিয়ে দিয়েছে। এটি সময়োপযোগী এবং কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ হুমা বাকাই মনে করেন, এই প্রতিরক্ষা চুক্তি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারে এবং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে।

তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধ সবার কাছে পাকিস্তান ও চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, যা সম্ভবত এ চুক্তির পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তার মতে, এর ফলে অন্যান্য উপসাগরীয় ও আরব দেশও এমন চুক্তির পথে হাঁটতে পারে। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্রদূত আইজাজ চৌধুরী সৌদির সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তিকে ‘বড় অগ্রগতি’ আখ্যা দিয়ে বলেন, সৌদিরা তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধুর দিকেই হাত বাড়িয়েছে। যদিও আগে থেকেই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ছিল, তবে এই নতুন ধারায় এক দেশের ওপর আক্রমণকে অপর দেশের ওপরও আক্রমণ হিসেবে গণ্য করার বিষয়টি একেবারেই অভূতপূর্ব।

এসএস/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পুরনো কুচক্রীরা হাসিনা-মার্কা সুরে কথা বলছে : ইশরাক হোসেন Nov 09, 2025
img
রংপুর রাইডার্স ছেড়ে নতুন ঠিকানায় শেখ মেহেদী! Nov 09, 2025
img
‘ইসলামকে অবমাননা করে কেউ রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে না’ Nov 09, 2025
img
চাকরি আইনের সঙ্গে সরাসরি ‘সাংঘর্ষিক’ হবে আইজিপি নিয়োগ Nov 09, 2025
img
আজকে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম Nov 09, 2025
img
বিক্ষোভে উত্তাল পর্তুগাল, রাজপথে হাজারও মানুষ Nov 09, 2025
img
দূষিত শহরের শীর্ষে ভারতের দিল্লি, ৪র্থ অবস্থানে রাজধানী ঢাকা Nov 09, 2025
img
শুষ্ক থাকবে ঢাকার আবহাওয়া, অপরিবর্তিত থাকবে দিনের তাপমাত্রা Nov 09, 2025
img
‘ধানের শীষের বিজয় মানেই নৌকার বিজয়’, বিএনপি প্রার্থীর বিতর্কিত মন্তব্যে বিক্ষোভ Nov 09, 2025
img
সাতক্ষীরা জেলায় প্রথম নারী ডিসি আফরোজা আখতার Nov 09, 2025
img
জানুয়ারিতেই চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিরছেন মেসি Nov 09, 2025
img
শেরপুরে জাল নোটসহ আটক ১ Nov 09, 2025
img
ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের তিন নেতাকর্মী কারাগারে Nov 09, 2025
img
দুর্দান্ত শুরুর পরও জয় হাতছাড়া আর্সেনালের Nov 09, 2025
img
তিন যুগ পর অক্ষয়ের সঙ্গে বাগদান নিয়ে কথা বললেন রাভিনা Nov 09, 2025
img
দ্বিতীয় দিনেও যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল Nov 09, 2025
img
জীবনযুদ্ধে টিকে থাকাই যেন বড় চ্যালেঞ্জ দীপিকার Nov 09, 2025
img
এনসিপিই আগামী দিনের সরকার গঠন করবে: মাহবুব আলম Nov 09, 2025
img
সৌদি প্রো লিগে নতুন ইতিহাস গড়লেন রোনালদো Nov 09, 2025
img
চট্টগ্রামে জাতীয় বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা শুরু আজ Nov 09, 2025