সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি যেভাবে বদলে দেবে ভূরাজনীতি

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে গত বুধবার সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে একটি “কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি” স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। এ সময় সৌদি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান, লাল গালিচা ও পূর্ণ রাজকীয় মর্যাদায় তাকে স্বাগত জানানো হয়।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুই দেশের আট দশকের পুরোনো সম্পর্কের এই চুক্তি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদের রাজকীয় কোর্টে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরবের শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল। সৌদি আরব ইসলাম ধর্মের দুই পবিত্র স্থান পরিচালনা করে এবং পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ।

চুক্তিটি এমন এক সময় এলো, যখন অঞ্চলের রাজনীতি চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলের আগ্রাসন, গাজায় যুদ্ধ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে হামলা এবং সর্বশেষ কাতারের রাজধানী দোহার ওপর হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি এক নতুন মোড় নিয়েছে।

তাছাড়া, মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার চার দিনের সীমান্ত সংঘর্ষ, যা উভয় পক্ষের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে চালানো হয়, পরিস্থিতিকে প্রায় পরমাণু যুদ্ধের দিকেই নিয়ে গিয়েছিল।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা জোরদার এবং আঞ্চলিক শান্তি নিশ্চিত করার এক অভিন্ন অঙ্গীকারের প্রতিফলন। চুক্তিতে বলা হয়েছে, “যেকোনো একটি দেশের ওপর আক্রমণ হলে তা উভয় দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হবে।”

চুক্তিটি একটি মাইলফলক

ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আসফান্দইয়ার মির বলেছেন, “এই চুক্তি উভয় দেশের জন্যই এক মাইলফলক।”

তিনি বলেন, “শীতল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল, কিন্তু তা ’৭০ দশকে ভেঙে পড়ে। এমনকি চীনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক থাকলেও, আনুষ্ঠানিকভাবে এমন প্রতিরক্ষা চুক্তি নেই।”

সিডনির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির দক্ষিণ এশিয়া নিরাপত্তা গবেষক মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, এটি একটি মডেল হতে পারে পাকিস্তানের জন্য যাতে করে তারা ভবিষ্যতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের সঙ্গেও এমন দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গড়তে পারে।

তিনি বলেন, “এই চুক্তি এখনকার চলমান সহযোগিতাকে আরও কাঠামোবদ্ধ করবে এবং যৌথ প্রশিক্ষণ, প্রতিরক্ষা উৎপাদন, এমনকি সৌদিতে পাকিস্তানি সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানো এসব দিক বিবেচনা করা হবে।”

ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও সামরিক সহযোগিতা

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল সৌদি আরব। ১৯৫১ সালে দুই দেশ ‘মৈত্রী চুক্তি’ করে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে।

১৯৬৭ সাল থেকে পাকিস্তান সৌদি সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে এবং কয়েকবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সৌদিতে মোতায়েন করা হয়েছে। ১৯৮২ সালের একটি চুক্তি এই সহযোগিতাকে আরও সুসংহত করে।

কিন্তু এই নতুন চুক্তি এমন সময় এলো, যখন মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি অস্থির। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ, প্রতিবেশী দেশে হামলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতা এসব নিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলো উদ্বিগ্ন।

ইসরায়েল ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় হামলা চালায়, যেখানে হামাস নেতারা অবস্থান করছিলেন এবং এতে কাতারের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন। এতে উপসাগরীয় দেশগুলো একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা বলে।

ফয়সাল বলেন, “এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান-সৌদি চুক্তিকে দেখলে বোঝা যায়, উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির প্রতি আস্থা কমে আসছে।”

ভারতের প্রতিক্রিয়া

চুক্তির বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। এপ্রিলের পাহেলগাম হামলায় ২৬ জন বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে যা ইসলামাবাদ অস্বীকার করেছে। এরপর মে মাসে দুই দেশ চার দিনের যুদ্ধ করে, যেখানে উভয় দেশই একে অপরের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

বৃহস্পতিবার, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “আমরা এই চুক্তির বিষয়ে অবগত। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর এর প্রভাব খতিয়ে দেখব।”

ফয়সাল বলেন, “এই চুক্তি পাকিস্তানের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। যেখানে আগে সম্পর্কের ভিত্তি ছিল সৌদি আরবের আর্থিক সহায়তা, এখন নতুন এক ভারসাম্য তৈরি হয়েছে।”

সৌদির পরমাণু আকাঙ্ক্ষা ও পাকিস্তান

সৌদি আরব বহুদিন ধরেই পারমাণবিক শক্তি (শুধুমাত্র বেসামরিক ব্যবহারের জন্য) অর্জনে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত মার্কিন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের বইয়ে বলা হয়, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকে বলেছিলেন, “আমার বোমা বানানোর জন্য ইউরেনিয়ামের দরকার নেই। আমি পাকিস্তান থেকেই একটি কিনে নেব।”

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তিতে পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত কোনো ইঙ্গিত নেই।

ওয়াশিংটনের বিশ্লেষক সাহার খান বলেন, “এই চুক্তি একটি পারমাণবিক ছায়া সৃষ্টি করছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা, বাস্তব সামরিক জোট নয়।”

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ফরিদপুরে জেমসের কনসার্টে হামলা-ভাঙচুর Dec 27, 2025
img
কুষ্টিয়ায় পিকআপ দুর্ঘটনায় প্রান হারাল ২ Dec 27, 2025
img
সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা Dec 27, 2025
img
হলিউডের ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ সিরিজের মাধ্যমে নতুন যাত্রা শুরু করলেন কাজল? Dec 27, 2025
img
স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়ের পরিচয়ে ‘রাজনৈতিক কর্মী’ লিখলেন তারেক রহমান Dec 27, 2025
img
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় নেতারা বাস ব্যবহার করেন কেন? Dec 27, 2025
img
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের নতুন বার্তা Dec 26, 2025
img
ভূমিকম্প অনুভূত, উৎপত্তিস্থল কোথায়? Dec 26, 2025
img
বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষে ভোট করবেন রাশেদ খান: নুর Dec 26, 2025
img
জনপ্রিয় ফিলিস্তিনি অভিনেতা মোহাম্মদ বকরী আর নেই Dec 26, 2025
img
মেঘনায় মিলল ২৩ কেজি ওজনের কোরাল Dec 26, 2025
img
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় নেতারা কেন বাস ব্যবহার করেন? Dec 26, 2025
img
জাতীয় স্মৃতিসৌধে তারেক রহমানের শ্রদ্ধা নিবেদন Dec 26, 2025
img
চারে ব্যাটিং প্রসঙ্গে ওপেনার ইমনের মন্তব্য Dec 26, 2025
img
মায়ানমারের সাধারণ নির্বাচন ঘিরে সমালোচনার ঝড় Dec 26, 2025
img
ঘন কুয়াশার কারণে আরিচা-কাজীরহাট নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ Dec 26, 2025
img
৫ লাখ সন্ন্যাসী নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস ঘেরাওয়ের হুমকি বিজেপি নেতার Dec 26, 2025
img
বান্দরবানে ভূমিকম্প অনুভূত Dec 26, 2025
img
মায়ানমারে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ মশারি ও নৌকার প্রপেলার জব্দ, আটক ৫ Dec 26, 2025
img
সম্রাট বাহিনীর প্রধানের প্রাণহানির ঘটনায় মামলা Dec 26, 2025