তরুণ প্রজন্ম নতুন সভ্যতার প্রধান স্থপতি হবে : প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এই নতুন সভ্যতার প্রধান স্থপতি হবে তরুণ প্রজন্ম। পূর্ববর্তী প্রজন্ম যেখানে পুরনো ব্যবস্থায় গড়ে উঠেছিল, সেখানে আজকের তরুণরা দেখতে পাচ্ছে- কেবল কী আছে তা নয়, বরং কী হতে পারে। তাদের কল্পনা সীমাহীন।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘সামাজিক ব্যবসা, যুবসমাজ ও প্রযুক্তি’ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের সাইড ইভেন্টে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, আমি যে পদেই থাকি না কেন, আমার লক্ষ্য অপরিবর্তিত- এমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলা যেখানে সবার জন্য সুযোগ, মর্যাদা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে। পদবি বদলাতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য একই থাকে- এমন এক পৃথিবী নির্মাণ করা, যেখানে ব্যবসা শুধু মুনাফার জন্য নয়, বরং মানুষের জন্য, পৃথিবীর জন্য এবং আমাদের সবার যৌথ ভবিষ্যতের জন্য কাজ করবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের দাবানল পৃথিবীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। বৈষম্যের গভীরতা বাড়ছে।

সর্বত্র সংঘাত চলছে, ন্যায় ও শান্তির সংগ্রাম আমাদের মানবতাকেই পরীক্ষার মুখে ফেলছে। এই সংকটগুলো আলাদা নয়, পরস্পর জড়িত- একটি ভঙ্গুর গালিচার সুতার মতো, যা একে অপরকে টেনে আমাদের সমগ্র অস্তিত্বকে প্রভাবিত করছে। তবে মনে রাখতে হবে, সেই গালিচা মেরামত করার শক্তি অতীতে নেই, তা লুকিয়ে আছে সেই ভবিষ্যতে, যা আমরা কল্পনা করতে সাহস করি- এবং আজ, এখানেই আমরা যে সিদ্ধান্ত নিই তাতেই।

তিনি বলেন, ভালো পৃথিবীর পথ গতকালের ব্যর্থতায় মাপা যায় না। সেটি গড়ে ওঠে আজকের সাহসে, আজকের পদক্ষেপে, আর আজকের দৃঢ় অঙ্গীকারে। আজকের বৈশ্বিক সংঘাত শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য স্থায়ী হুমকি। যুদ্ধ ও বাস্তুচ্যুতি সীমান্ত অতিক্রম করে অর্থনীতি বিপর্যস্ত করছে, খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে এবং অসংখ্য মানুষের জীবন ভেঙে দিচ্ছে। এসব জটিল সংকটের মুখে পুরনো সমাধান যথেষ্ট নয়। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো নবায়িত বহুপাক্ষিক কূটনীতি, গভীরতর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতি সমবেত অঙ্গীকার।

ড. ইউনূস বেলেন, অনেক দেশ, বিশেষত বাংলাদেশ, প্রবল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর অর্থ হলো- ১৩ লাখ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া, বারবার জলবায়ু দুর্যোগ সামলানো এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে টিকে থাকা। এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের বাজেট কমানো বা সরকারি উন্নয়ন সহায়তা হ্রাস করা বিপরীত ফল বয়ে আনবে। বরং বিশ্বকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে, প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ন্যায্য রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান কেবল শূন্য কূটনৈতিক আলাপে হবে না। আমাদের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে- যা এখনো মূলত মানুষের ওপরে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথ অনেক সময় অন্ধকার মনে হতে পারে। তবে আমি এখানে নিরাশার গল্প বলতে আসিনি। আমি এসেছি একটি রূপান্তরের প্রস্তাব নিয়ে- একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য।

তিনি বলেন, এই নতুন অর্থনীতি মানুষের কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশ সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে- শুধু সম্পদ সঞ্চয় নয়। এটি কোনো কল্পনার স্বপ্ন নয়- বরং প্রয়োজনীয় এক বিবর্তন। আর এই নতুন অর্থনীতির কেন্দ্রে রয়েছে সামাজিক ব্যবসা। সামাজিক ব্যবসা কোনো ছোটখাটো ধারণা নয়। এটি একটি মৌলিক নীতি। ব্যবসা কেবল মুনাফার জন্য নয়, বরং পরিবর্তন আনার জন্য বিদ্যমান। এটি এক ডলারের ঋণ থেকে শুরু হলেও আজ এটি একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিক্ষা থেকে ক্রীড়া- সব ক্ষেত্রেই সামাজিক ব্যবসা প্রমাণ করছে, অর্থনৈতিকভাবে টিকে থেকেও বিশ্বের সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের বর্তমান সভ্যতা এক আত্মবিধ্বংসী পথে হাঁটছে, যেখানে সীমাহীন ভোগ, আহরণ ও সঞ্চয় আমাদের গ্রহকে হুমকির মুখে ফেলছে। আমাদের নতুন সভ্যতা গড়তে হবে- যেখানে লোভ নয়, বরং যৌথ প্রতিশ্রুতি মানুষ ও প্রকৃতির সমস্যার সমাধানকে চালিত করবে। এই নতুন দুনিয়ায় সম্পদ ভাগাভাগি করতে হবে, কেন্দ্রীভূত নয়। ব্যবসাকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে হবে- ব্যক্তিগত মুনাফার যান হিসেবে নয়, বরং সামাজিক কল্যাণের ইঞ্জিন হিসেবে। এবং এই নতুন সভ্যতার প্রধান স্থপতি হবে তরুণ প্রজন্ম। পূর্ববর্তী প্রজন্ম যেখানে পুরনো ব্যবস্থায় গড়ে উঠেছিল, সেখানে আজকের তরুণরা দেখতে পাচ্ছে কেবল কী আছে তা নয়, বরং কী হতে পারে। তাদের কল্পনা সীমাহীন। আমি প্রায়ই বলি: ‘যেখানে কল্পনা নেতৃত্ব দেয়, সেখানে উদ্ভাবন অনুসরণ করে।’ তাই তরুণদের কল্পনা ও সৃজনশীলতাকে সোশ্যাল বিজনেসের দিকে চালিত করতে হবে- যেখানে টেকসই সমাধান জন্ম নেয় জলবায়ু পরিবর্তন, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের মতো সমস্যার।

তিনি আরো বলেন, আমরা এক নতুন প্রযুক্তিগত যুগের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি- যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং অন্যান্য রূপান্তরমূলক উদ্ভাবন রয়েছে।

এই উপকরণগুলো শিল্প, সমাজ ও মানব অগ্রগতির কাঠামোকে পুনর্গঠন করতে পারে। যদি দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ইন্টারনেট অব থিংস- এসব প্রযুক্তি টেকসই উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। ডিজিটাল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে শুরু করে ক্রীড়া ক্ষেত্রেও এগুলো এক বিপ্লব আনতে পারে।
সবশেষে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, চলুন আমরা নতুন এক তরঙ্গের স্থপতি হই, যেটি ন্যায়, টেকসই উন্নয়ন এবং আশার ওপর গড়া এক পৃথিবী। এমন এক পৃথিবী, যেখানে আমাদের যৌথ স্বপ্ন মানবজাতির জন্য এক নতুন ভোর নিয়ে আসবে।

কেএন/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক আইজিপি মামুনের ৫ বছর কারাদণ্ড Nov 17, 2025
img
কালকের ম্যাচে অনেক হলুদ কার্ড হবে, গালাগালি হবে : জামাল ভূঁইয়া Nov 17, 2025
img
ন্যায়বিচারই জাতিকে ট্রমা থেকে মুক্তি দিতে পারে : ফারুকী Nov 17, 2025
img
মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ Nov 17, 2025
img
সাত কলেজ উন্নয়নে সম্মিলিত সুপারিশ অংশীজনদের Nov 17, 2025
img
সরকারি কর্মকর্তাদের ভোটের ব্যবস্থা করা হবে: এ এম এম নাসির উদ্দিন Nov 17, 2025
img
২৯ বাংলাদেশি জেলেকে আটক ভারতের Nov 17, 2025
img
মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত শেখ হাসিনা: ট্রাইব্যুনাল Nov 17, 2025
img
শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে গণঅধিকার পরিষদের বিক্ষোভ Nov 17, 2025
img
কারাতে প্রশিক্ষণ দ্বারা সামাজিক বাধা অতিক্রম করছে ইরানের তরুণীরা Nov 17, 2025
img
আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য আরও কঠোর করা হচ্ছে যুক্তরাজ্যের আইন Nov 17, 2025
img
ট্রাম্পের অব্যাহত চাপের মধ্যেই, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় এলপিজি চুক্তি করল ভারত Nov 17, 2025
img
ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করতে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে : মাওলানা ইমতিয়াজ Nov 17, 2025
img
বন্ধু ছাঁটাই করার দিন আজ Nov 17, 2025
img
বেলিংহ্যামকে সতর্ক করলেন ইংল্যান্ড কোচ Nov 17, 2025
img
শেখ হাসিনা যাদের মায়া করে নাই, তাদের উচিত না তার জন্য মায়া দেখানো: রাশেদ খান Nov 17, 2025
img

মেহজাবীন চৌধুরী

‘ভাইরাল হওয়ার জন্য অন্যকে ব্যবহার করা খুবই সহজ’ Nov 17, 2025
img
রাজস্থান রয়্যালসের হেড কোচের দায়িত্বে সাঙ্গাকারা Nov 17, 2025
img
ধানমন্ডি ৩২-এর সামনে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, বুলডোজার সরানোর নির্দেশ Nov 17, 2025
img
রাজধানীতে আওয়ামী লীগের আরো ২৫ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার Nov 17, 2025