‘যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা শেষে ফিরতে হতে পারে বেশির ভাগ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে’ শিরোনামে দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ফাইন্যান্সে স্নাতকোত্তরে পড়ালেখা করতে ২০২১ সালে দেশ ছাড়েন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিরুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশটিতে কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ থাকায় দ্বিতীয় দফায় তিনি বিজনেস অ্যানালিস্ট অ্যান্ড ডাটা সায়েন্সেস থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপও করেন। বর্তমানে সেখানেই কর্মরত আছেন বাংলাদেশি এ গ্র্যাজুয়েট। তবে সেখানে তার ওপিটি (অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং) পিরিয়ড প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন তিন বছরের মধ্যে এইচ-১বি (দক্ষ কর্মী) ভিসা পেলে থাকতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এ ক্যাটাগরির ভিসার ওপর ১ লাখ ডলার ফি আরোপ করায় বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মনিরুলের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি চাকরি করছেন, সেখান বছরে বেতন পান ৮০ হাজার ডলার। নতুন করে দক্ষ কর্মী ভিসায় কাজ নিয়ে থাকতে হলে তার পেছনে ১ লাখ ডলার স্পন্সর করতে হবে ওই কোম্পানিকে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এ অর্থ ব্যয় করে ওই কোম্পানি তাকে রাখবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে তার। তিনি মনে করছেন, বিপুল অর্থ ফি না দিয়ে ওই কোম্পানি গ্রিন কার্ড কিংবা মার্কিন নাগরিকত্ব আছে, এমন কাউকে বেছে নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেটের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি খুঁজছেন বাংলাদেশি তরুণ তাহমিদ জামান (ছদ্মনাম)। বর্তমানে তিনি ওপিটিতে রয়েছেন। ভিসার ওপর নতুন করে ১ লাখ ডলার আরোপ তার কর্মসংস্থান নিয়ে আরো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গ্র্যাজুয়েট।
তাহমিদ জামান বলেন, ‘বর্তমানে আমি ওপিটি পিরিয়ডে আছি। চাকরি খুঁজছি, বিভিন্ন কোম্পানিতে। সাক্ষাৎকারও দিয়েছি। কিন্তু চাকরি পাচ্ছি না। সম্প্রতি একটি কোম্পানিতে পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়েছে, সেখানে তিনজন আমেরিকান ও দুজন বিদেশী। কিন্তু ট্রাম্পের ফি ঘোষণার আগে ওই প্রতিষ্ঠানে বিদেশী কর্মী নিয়োগের হার ছিল বেশি।’
অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং বা ওপিটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রে এফ-১ ভিসায় পড়াশোনা শেষে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য কাজের সুযোগ। এ সময়ের পর যদি কোনো গ্র্যাজুয়েটকে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি রাখতে চায়, তাহলে দেশটির সরকারের কাছে এইচ-১বি ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত বেশ কয়েকজন অভিবাসী কর্মী জানান, যারা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশটিতে আসেন তারা মূলত এফ-১ ভিসা (পড়াশোনার জন্য নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা) নিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করে। এরপর পড়াশোনা শেষে কর্মসংস্থান মিললে তাদের ভিসা ক্যাটাগরি এইচ-১বি (যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কাজের ভিসা) ভিসায় রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এইচ-১বি ভিসায় ১ লাখ ডলার ফি আরোপ করায় উচ্চতর পড়াশোনা থেকে কর্মসংস্থান মিলবে কিনা তা নিয়ে বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কাজ না মিললে বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে ফিরে আসতে হতে পারে অধিকাংশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর।
দক্ষ কর্মী ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর অভিবাসীদের ১ লাখ ডলার ফি দেয়ার নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ১৯ সেপ্টেম্বর এ-সংক্রান্ত এক নির্বাহী আদেশে সইও করেন তিনি। দক্ষ কর্মী ভিসা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১বি ভিসা ক্যাটাগরি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণার পর এ ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে গমন করা অভিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের নাগরিকদের। তবে ভিসার ওপর বড় ধরনের এ ফি আরোপে বাংলাদেশিদেরও বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন না অভিবাসন-সংক্রান্ত আইন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে বাংলাদেশি শিক্ষকরাও।
তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ কর্মী ভিসায় কম নাগরিক গেলেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও গ্র্যাজুয়েটরা প্রবেশ করছেন। যাদের অনেকে পড়াশোনা শেষে দেশটিতে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করেন। এইচ-১বি ভিসার ওপর বড় ধরনের এ ফি আরোপ কর্মসংস্থান পেতে বাংলাদেশিদের বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা বলছেন, এ ধরনের ভিসায় মার্কিন কোম্পানিগুলো বিদেশী কর্মী গ্রহণে ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করবেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসী কর্মী গ্রহণেও অনিচ্ছা প্রকাশ করার বড় শঙ্কা রয়েছে। অনেকেই চাকরি হারাবে, আবার অনেককে দেশে ফেরত আসতে হবে। কেউ কেউ হয়তো বিকল্প পথ খুঁজে নেবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত আছেন বাংলাদেশি এক শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে ৯০ হাজার ডলারে চাকরি করি। এখন পর্যন্ত গ্রিন কার্ড পাইনি, এইচ-১বি ভিসা পাইনি। আমার ভিসার জন্য যেহেতু বেতনের বাইরে ১ লাখ ডলার ফি দিতে হবে, তাই আশঙ্কা করছি আমাকে হয়তো দেশে ফিরে যেতে হবে। এত টাকা দিয়ে আমাকে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্বিবেচনা করবে না।’
দেশ থেকে প্রতি বছর উচ্চতর ডিগ্রি ও গবেষণার জন্য বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। যাদের অনেকে আবার স্থায়ীভাবে থাকার জন্য দ্বিতীয় দফায় একই ডিগ্রি গ্রহণ করছেন। ২০২৫ সালে ঠিক কী পরিমাণ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে ২০২৪ সালে ‘ওপেন ডোরস রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জ’-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রবেশ করেছেন ১৭ হাজার ৯৯ জন, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের তুলনায় এ সংখ্যা ২৬ শতাংশ বেশি। এ বৃদ্ধি বাংলাদেশকে এক বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পাঠানো দেশের তালিকায় ১৩তম স্থান থেকে অষ্টম স্থানে নিয়ে এসেছে। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৮০২ জন। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এফ-১ স্টুডেন্ট ভিসায় বসবাসরত এবং ওপিটি পিরিয়ডে চাকরি করছেন এমন ছয় বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের প্রত্যেকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বাংলাদেশি পড়াশোনা করতে যান, তাদের মূলত স্থায়ী বসবাসের জন্য একটা মৌলিক প্রচেষ্টা থাকে দেশটিতে কর্মসংস্থান খুঁজে নেয়ার। কিন্তু ভিসা নিয়ে ট্রাম্পের নতুন আদেশ তীব্রভাবে অস্বস্তিতে ফেলেছে চাকরিপ্রার্থীদের। তারা জানান, তথ্যপ্রযুক্তি খাত ছাড়া বাংলাদেশিরা যেসব খাতে চাকরি করেন, সেখানে বছরে গড় বেতন ১ লাখ ডলারের নিচে। ফলে এক বছরের সমপরিমাণ ভিসায় নতুন ফি দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানই চাইবে না কর্মী নিয়োগ করতে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি খাতে অন্য যেকোনো কাজের তুলনায় বেতন তিন থেকে চার গুণ বেশি। যেসব কর্মী অনেক বেশি দক্ষ এবং যাদের বেতন বেশি তাদের বিষয়ে হয়তো কোম্পানি বিবেচনা করবে। কিন্তু যাদের বেতন ১ লাখ ডলারের নিচে তাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো বিকল্প চিন্তা করবে বলে জানান তারা।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১বি ভিসাধারীদের একটি বড় অংশ ভারতীয় ও চীনা নাগরিক। মার্কিন নাগরিকত্ব ও অভিবাসন পরিষেবা পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমান এইচ-১বি ভিসার ৭১ শতাংশ ভারতীয় নাগরিক, চীনা নাগরিক ১২ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ফিলিপাইন, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, তাইওয়ান এবং পাকিস্তান, ব্রাজিল ও নাইজেরিয়ান নাগিরকরা। এর বাইরে ১০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাগরিক। তবে এইচ-১বি ভিসায় নতুন ফি আরোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন ভারতীয় ও চীনা নাগরিকরা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী চীন ও ভারতের নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মরত রয়েছেন।
প্রতি বছর উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন বিদেশী পেশাজীবীদের আকৃষ্ট করতে এইচ-১বি ওয়ার্ক ভিসা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তথ্যপ্রযুক্তি, প্রকৌশল, চিকিৎসা, গবেষণার মতো বিশেষায়িত ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মী নিয়োগে মার্কিন কোম্পানিগুলো বিদেশী নাগরিকদের এ ভিসা স্পন্সর করে। এ ভিসাধারী ব্যক্তি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পরে গ্রিন কার্ডের আবেদন করতে পারেন।
দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার্থীদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা থেকে দক্ষ কর্মসংস্থানে রূপান্তরের জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য আইনি পথ ছিল এইচ-১বি ভিসা। মার্কিন অভিবাসন নীতির হঠাৎ এ পরিবর্তনে দেশটিতে বাংলাদেশি গ্র্যাজুয়েটদের এবং পিএইচডিধারীরাও বলছেন যে ভিসা ফি বৃদ্ধির ফলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ও উদ্বেগ তৈরি করেছে। যারা দেশটিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরিকল্পনা করছিলেন তারাও নানা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘সোচ্চার’-এর প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ড. শিব্বির আহমদ বলেন, ‘মূলত এটি ট্রাম্পের একটি পলিসি যে তারা স্থানীয়দের জন্য চাকরির সুযোগ বাড়াচ্ছেন। কোম্পানিগুলো যখন বাইরের দেশ থেকে কর্মী নেয় তখন এইচ-১বি ভিসার স্পন্সর করেন। ভারতীয়রা সাধারণত আইটি সেক্টরে এ ধরনের ভিসা বেশি পান। আর বাংলাদেশ থেকে যারা আসেন, তারা এফ-১ ভিসায় অর্থাৎ স্টুডেন্ট ভিসায় প্রবেশ করেন। সাধারণত স্টুডেন্ট ভিসা থেকে ওপিটি পিরিয়ডে চাকরিতে জয়েন করেন বাংলাদেশিরা। তিন বছর ওপিটিতে থাকার পর এইচ-১বি ভিসায় রূপান্তর হয়। এইচ-১বি ভিসায় রূপান্তরের অর্থ হলো পরবর্তী ছয় বছরের জন্য ওই ব্যক্তির ভিসার মেয়াদ থাকবে যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদনও করতে পারবেন তিনি।’
জানা গেছে, এইচ-১বি ভিসায় ১ লাখ ডলার ফি ধার্য করার পর কোম্পানিগুলো আগের মতো বিদেশী কর্মী নিতে অস্বীকৃতি জানাবে। যারা স্টুডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, তারা হয়তো তিন বছর ওপিটি ভিসায় কাজ করতে পারবেন সর্বোচ্চ। তবে বিকল্প থাকবে বাংলাদেশ থেকে যারা পিএইচডি, সায়েন্টিফিক ও একাডেমিক ক্যাটাগরিতে আসেন। তারা হয়তো গ্রিনকার্ড আবেদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সমস্যা হবে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের।
পিএ/টিকে