“আমরা ঢাকা কেন্দ্রিক ক্রিকেট চাই না। আমি চাই না কেউ রংপুরের টিম, চট্টগ্রামের টিম ঢাকায় বসে করে দিক। রংপুরে একটা বিসিবি থাকবে, এখানে সিলেকশন কমিটি থাকবে তারা বিভিন্ন এইজগ্রুপে সিলেকশনের কাজ করবে। রংপুরের ছেলে ও মেয়েদের একটি টিম থাকবে, যারা গোটা দেশের সঙ্গে লড়াই করে শিরোপা আনবে এবং পরবর্তীতে জাতীয় দলের জন্য কাজ করবে। আমরা ক্রিকেট ক্রেজিনেসকে ছড়িয়ে দিতে চাই। যেন রংপুরের খেলা দেখতে মানুষ রাজশাহীতে বাস ভরে চলে যায়।” কথাগুলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের।
গত ২৮ জুন রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টেস্ট স্ট্যাটাসের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ক্রিকেট কার্নিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছিলেন তিনি।
ঢাকার বাইরেও হচ্ছে বিসিবির অফিস, যেসব পরিকল্পনা বুলবুলের
জুলাই বিপ্লবের মহানায়ক শহীদ আবু সাঈদের পুণ্যভূমিতে পা রেখে রংপুরের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের চেষ্টা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি। পাশাপাশি দক্ষ খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফ তৈরিতে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন ধারায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছিলেন তিনি।
রংপুরের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের কথা কয়েক মাসের ব্যবধানে ভুলে গেছেন বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বৈষম্যের চাদরে বরাবরের মতো এবারও রংপুরকে মুড়িয়ে রেখে সাজানো হয়েছে তৃণমূলে ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা।
দেশের ৬টি বিভাগীয় শহরে আঞ্চলিক অফিস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে বিসিবির। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা এবং বরিশাল বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিসিবি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। পরিকল্পনার এ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসার পর বইছে সমালোচনার ঝড়। বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার রংপুর বিভাগের ক্রীড়ামোদিরা মন যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেছে হতাশা আর ক্ষোভে।
সামাজিক যোগমাধ্যম ফেসবুকে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, সাবেক ক্রিকেটার ও প্রশিক্ষক আরিফা জাহান বীথিসহ বিভিন্নজন জানিয়েছে প্রতিবাদ। তুলে ধরেছেন দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস ও হতাশার কথা।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম লিখেছেন, ‘বিসিবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুলবুল ভাই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আপনাকে অভিনন্দন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই আপনি বিভাগীয় পর্যায়ে বিসিবির অফিস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন এই জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু রংপুর বিভাগ বাদ দিয়ে বাকি ৭ বিভাগে বিভাগীয় অফিস স্থাপনের উদ্যোগ আমাদেরকে মর্মাহত করেছে। রংপুর বিভাগে আটটি জেলা রয়েছে। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভাগকে অন্য আরেকটি বিভাগের অধীনে করে দেওয়া এই বিভাগের ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।’
সারজিস আলম আরও লিখেছেন, ‘ক্রিকেটে ফ্যাসিলিটিজ এর দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া বিভাগ রংপুর। যাদের একটা ভালো মাঠও নাই। আন্তর্জাতিক মাঠ তো দূরের কথা! তাই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, বিসিবি প্রেসিডেন্ট বুলবুল ভাইসহ পলিসি মেকিং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান থাকবে- অন্য সাতটি বিভাগের মত রংপুর বিভাগেও অবশ্যই বিসিবি বিভাগীয় অফিস থাকতে হবে। পাশাপাশি অতি দ্রুত রংপুরে একাধিক ভালো মাঠ এবং অন্তত একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের মতো মাঠ তৈরি করতে হবে।
আমরা আপনাদের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ অনুসরণ করব। অতিরিক্ত কিছু আমাদের দিতে হবে না। কিন্তু যেটুকু রংপুরের প্রাপ্য সেটুকুতে রংপুরবাসীকে বঞ্চিত করা হলে সেটাও তারা মেনে নেবে না। রংপুরের সাথে যেমন আচরণ করা হবে রংপুরও আগামীতে তাই ফিরিয়ে দেবে।’
অন্যদিকে উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি অ্যান্ড হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক ক্রিকেটার ও প্রশিক্ষক আরিফা জাহান বিথী লিখেছেন, ‘আন্দোলনের নাম ছিল “বৈষম্য বিরোধী”- কিন্তু আজ বিসিবির সিদ্ধান্তগুলো দেখে মনে হচ্ছে, সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধাচার নয় বরং তার চর্চাই চলছে নতুন করে।এই আন্দোলনের ফলেই বিসিবির চেয়ার গুলো পেয়েছেন।এখন যারা আসনে বসেছেন, তারা যেন ভুলে যাচ্ছেন-কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই অবস্থানে এসেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সিদ্ধান্ত নেয় কারা? যারা নিচ্ছে, তাদের ক্রিকেট সম্পর্কে কতটুকু ধারণা আছে সেটাও প্রশ্নের জায়গায় পড়ে।’
রংপুর বিভাগীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই ম্যানেজার আরও লিখেছেন, ‘যখন বিপিএল দল গঠনের সময় “রংপুর রাইডার্স” নামটা নেওয়া হয়েছিল, তখন তো কেউ “রাজশাহী–রংপুর” নামে একসাথে দল করেননি! তাহলে এখন কাজের বেলায় কেন রাজশাহীকে রংপুরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে? রংপুর একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ, যেখানে ৮টি জেলা আছে। তাহলে কেনো এখন “রাজশাহী ও রংপুর একত্রে কাজ করবে” বলা হচ্ছে? এটা কেবল অন্যায় নয়, রংপুরবাসীর প্রতি এক ধরনের অবমূল্যায়ন।’
তিনি লিখেছেন, ‘আগের বোর্ডে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা যেমন দেখেনি রংপুরের প্রতি এমন অবিচার ছিল? এখন “পরিবর্তনের নামে” নতুন বোর্ড এসে যদি পুরনো বৈষম্যকেই সাজিয়ে উপস্থাপন করে তাহলে সেটি উন্নতি নয়, নাটক। ক্রিকেট নিয়ে এই নাটক বন্ধ করুন। রংপুরের দলকে নিয়ে যেভাবে খেলছেন, সেটা অপমানের শামিল। এনসিএল-এ ছেলে বা মেয়ে বরাবর চ্যাম্পিয়ন রংপুর, এটা ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু যখন মেয়েদের এনসিএল দল তৈরি হয়, তখন দেখা যায় রংপুর বিভাগের মেয়েদের বেশিরভাগকেই অন্য বিভাগে দিতে হয়, কারণ সেই বিভাগে নিজেদের পর্যাপ্ত খেলোয়াড়ই নেই! তখন তো মনে পড়ে রংপুরের কথা!যখন নিজেদের প্রয়োজনে লাগে, তখন রংপুরের নাম ব্যবহার করেন; কিন্তু কাজের বেলায় রংপুরের নাম আসে না-এই দ্বিচারিতা কেন?’
আরিফা জাহান বিথী বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানিয়ে লিখেন, ‘রংপুরের ক্রিকেটের ইতিহাস, সাফল্য আর সম্ভাবনাকে বারবার অবমূল্যায়ন করা বন্ধ করুন। রংপুর মানে শুধু একটি শহর নয়- এটি বাংলাদেশের ক্রিকেট মানচিত্রের একটি শক্ত স্তম্ভ। এই বিভাগকে অবহেলা করা মানে দেশের ক্রিকেটকেই পিছিয়ে দেওয়া।’
এবি/টিকে