সম্প্রতি ঢাকায় নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন আরাল্ড গুলব্রানসেন, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিনাস রাগনার উইকস এবং ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মলার আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তার গুলশানের বাড়িতে বৈঠক করেছেন। গত সোমবার দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে শুরু হয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অত্যন্ত গোপনীয়তায় চলে এ বৈঠক। এ নিয়ে রাজনীতি চলছে তুমুল আলোচনা।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান।
বাংলাদেশে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড থেকে সৃষ্ট বৈশ্বিক উদ্বেগের কারণে ইউরোপ আওয়ামী লীগকে কোনো ফর্মে ফেরত আনার চেষ্টা করছে কি না, সে বিষয়ে নিজের ধারণা তুলে ধরেছেন তিনি।
জাহেদুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বাসায় গিয়ে দীর্ঘ সভা করেছেন তিনটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা। এ নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে নিয়ে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রকাশিত খবরের কেউ প্রতিবাদ করেনি। যার অর্থ বৈঠকের তথ্যটি সত্য। কেন তারা বৈঠকটি করেছেন এ নিয়ে নানা কথা বলা হচ্ছে। এটা খুবই স্বাভাবিক, যদি ৫ আগস্টের পর সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আমরা বিবেচনায় নিই।
প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন জাতীয় কোনো আলোচনা চলছে কি না? সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, লুকিয়ে বৈঠকটি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কূটনৈতিক কোনো চিহ্ন না রেখে ৩ রাষ্ট্রদূত একই গাড়িতে করে সাবের হোসেন চৌধুরীর গুলসানের বাসায় যান এবং দুই ঘণ্টার মতো সময় বৈঠক করেন।’
এখন সাবের হোসেন চৌধুরী ও তথাকথিত ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নিয়ে এত আলোচনা কেন—প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, সাবের হোসেন চৌধুরী একটা পর্যায়ে শেখ হাসিনার খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন না। ১/১১-এর সময় সংস্কারবাদী হওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এর পরও হয়তো শেখ হাসিনা তাকে ছাড় দিয়েছিলেন বলেন ২০১৪, ১৮, ২৪-এর নির্বাচনে তিনি তথাকথিত এমপি হয়েছিলেন।
সাবের হোসেন চৌধুরীকে আমরা অনেক আগে থেকেই চিনি। সংসদীয় ধারায় তিনি একজন সজ্জন মানুষ হিসেবেই পরিচিত। তার মতো মানুষ এই তথাকথিত নির্বাচনগুলোতে গেছেন, এমপি হতে চেয়েছেন; এটা তার ভাবমূর্তির সঙ্গে যায় না। সাবের হোসেন চৌধুরী ৫ আগস্ট পরবর্তী গ্রেপ্তার হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে জামিন পান।
তার জামিন পাওয়াটাই এক ধরনের প্রশ্ন তৈরি করে যে আওয়ামী লীগকে নতুন কোনো ফর্মে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে কি না? তিনিসহ তাজউদ্দীন পরিবার ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র আইভীকে জড়িয়ে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের চেষ্টা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছিল। কিছুদিন আগে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এ ধরনের একটা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন।’
তিনি বলেন, ইউরোপের এই রাষ্ট্রদূতরা এমন এক সময় এই বৈঠকটি করলেন, যখন এটা প্রায় নিশ্চিত যে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। এখন ইউরোপের এই রাষ্ট্রদূতরা কি এ বিষয়ে রাজি হচ্ছেন না? তারা কি চাচ্ছেন ভিন্ন কিছু হোক। তারা এটা কেন চাইবেন?
জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘আমরা যদি দেখি, বাংলাদেশে সাংবিধানিক ধর্মীয় রাজনীতি করে এ ধরনের দল নিয়ে পশ্চিমাদের খুব বেশি সমস্যা আছে বলে জানা যায় না। বরং তারা এ ধরনের দলগুলোকে সহায়তা দেওয়ার পক্ষে, কারণ তারা দেখাতে চায় সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ইসলামী রাজনীতি হতে পারে। এটা দেওয়া হলে কট্টরপন্থীদের ক্ষমতা দখল করার রাজনীতি সরিয়ে রাখা যাবে। তবে এ ব্যাপারে ইউরোপ সম্ভবত পুরোপুরি একমত নয়।
তারা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে খুব ইতিবাচক ধারণা রাখে বলে মনে হয় না। এ জন্য ইউরোপকে খুব বেশি দায়ী করা যাবে না। দল দুটি ক্ষমতায় এলে শরিয়া আইন কায়েম করবে বলে কথা বলছে। প্রশ্ন হলো, সাংবিধানিক রাজনীতি করে শরিয়া কায়েম করার কথা বললে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে এই দলগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে খাপসই কি না? জামায়াতের নেতৃত্বে যদি একটা ইসলামী মোর্চা হয় তাহলে বাংলাদেশে বিকল্প শক্তিটা তারাই হবে, যারা ইসলামী শরিয়া কায়েম করবে। এই জিনিসটাতে পশ্চিমাদের হয়তো সমস্যা আছে। ইউরোপের সমস্যাটাই বেশি আমেরিকার চেয়ে। সেই প্রেক্ষাপটে তারা ভাবছে কিনা একটা ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’।
তিনি বলেন, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ বলতে যারা আওয়ামী লীগের বড় কোনো পদে ছিলেন না, যাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই তারা মিলে যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তারা কিছু আসনে জিতে যাবে এবং তাদের আসন সংখ্যা ইসলামী জোটের চেয়েও বেশি হবে বলে আমি মনে করি। রাষ্ট্রদূতরা সেই ধরনের একটা হিসাব কষছেন কি না, সেটা ভাবার কারণ আছে বলে মনে করি। এই পরিস্থিতিটা ইসলামী দলগুলোই সৃষ্টি করেছে। সুতরাং তাদের ব্যাখ্যা দিতে হবে যে, ক্ষমতায় এলে তারা শরিয়া কায়েম করবে কি না; কায়েম করলে শরিয়া আইন কেমন হবে; কোন ক্ষেত্রে তারা কী প্রয়োগ করবে তার একটা বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হবে এ দেশের ভোটারদের জন্য।
এসব আগেই বলতে হবে। দলগুলোর অস্পষ্টতা সমাজে ও বিদেশিদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করছে। কাজেই পরিষ্কারভাবে মানুষের সামনে আসতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে তারা ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করছে। তাদের দিক থেকে সত্য লুকিয়ে রেখে রাজনীতি করা উচিত হবে না। ইসলামী দলগুলোর সাম্প্রতিক হাইপ, এর সঙ্গে তৌহিদি জনতার নামের নানা রকম কর্মকাণ্ড একটা বৈশ্বিক উদ্বেগ তৈরি করছে। সে কারণে কোনো ফর্মে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার চিন্তা তারা করছেন কি না, আমি নিশ্চিত নই।
আইকে/টিকে