মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরদের স্মরণ করলো সশস্ত্র বাহিনী

সেনাবাহিনী: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ও দমন-পীড়ন শুরু করলে আপামর জনসাধারণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যরা সর্বত্র দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ব্যাটালিয়নসহ অন্যান্য সেনাসদস্যরাও সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।

চট্টগ্রামে ৮ ইস্ট বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল, যশোরে ১ ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুরে ২ ইস্ট বেঙ্গল ও সৈয়দপুরে ৩ ইস্ট বেঙ্গল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই প্রতিরোধই মহান মুক্তি সংগ্রামের পথে প্রথম দৃঢ় পদক্ষেপ ছিল। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের পর কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) এম. এ. জি. ওসমানীকে কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে বাংলাদেশ ফোর্সেসের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। একই সঙ্গে দেশব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ভূখণ্ডকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পরবর্তীতে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরও তিনটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয় এবং গোলন্দাজ সহায়তা প্রদানের জন্য দুইটি আর্টিলারি ও একটি স্বতন্ত্র রকেট ব্যাটারি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজয়কে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে গড়ে তোলা হয় তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড জেড ফোর্স, এস ফোর্স এবং কে ফোর্স। পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ডাইরেক্টরেট অব মেডিক্যাল সার্ভিসেস’। সেনাবাহিনীর এই সংগঠিত ও পরিকল্পিত অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযুদ্ধে নতুন গতি ও দিকনির্দেশনা যুক্ত হয়।

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৫ জন অফিসারসহ মোট ১,৪৬০ জন বীর সেনাসদস্য চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সেনাবাহিনীর ৩ জন সদস্যকে বীরশ্রেষ্ঠ, ৩৯ জন সদস্যকে বীর উত্তম, ৯০ জন সদস্যকে বীর বিক্রম এবং ১৬৭ জন সদস্যকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

নৌবাহিনী: মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অবিস্মরণীয় ভূমিকা চূড়ান্ত বিজয় অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। তৎকালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি অফিসার ও নাবিক পশ্চিম পাকিস্তান ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হন। সেই সময় ফ্রান্সে প্রশিক্ষণরত তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীর কিছু সংখ্যক বাঙালি সাবমেরিনার নিজ দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে সংগঠিত হয় এবং তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গড়ে তোলে একটি দুর্ধর্ষ নৌ কমান্ডো দল।

অকুতোভয় এ সকল নির্ভীক তরুণ নৌ কমান্ডোগণ দেশের প্রধান নদী বন্দরগুলোতে দুঃসাহসী ‘অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনা করে রসদ বোঝাই প্রায় ২৬টি শত্রু জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এছাড়াও ৪৯ জন নাবিক ও ২টি গানবোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে খুলনার পশুর নদীতে ‘অপারেশন হটপ্যান্ট’ এর মাধ্যমে শত্রুদের যুদ্ধজাহাজ ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংস করে দিয়ে হানাদার বাহিনীর কৌশলগত সুবিধা চূড়ান্তভাবে বিপর্যন্ত করে দেয়। দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত নৌ কমান্ডোরা সারাদেশে অসংখ্য সফল অভিযান পরিচালনা করেন। নৌবাহিনীর এই দুঃসাহসিক অভিযানগুলো শত্রুপক্ষকে নৌপথে দিশেহারা করে তুলেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে বহুসংখ্যক নৌ সদস্য শাহাদত বরণ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ শহিদ রুহুল আমিন, ইআরএ-১ কে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও, ৫ জন সদস্যকে বীর উত্তম ৮ সদস্যকে বীর বিক্রম এবং ৭ জন সদস্যকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

বিমান বাহিনী: ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে সীমিত সম্পদ, অসংখ্য সীমাবদ্ধতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যত এবং চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ‘কিলো ফ্লাইট’ নামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই দিনে একটি অটার বিমান, একটি ড্যাকোটা বিমান এবং একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং বৈমানিক কারিগরি পেশার বিমানসেনা ও বেসামরিক বৈমানিকসহ ৫৭ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘কিলো ফ্লাই ‘। মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার এর প্রথম অক্ষর ‘কে’ থেকে ‘কিলো ফ্লাইট নামকরণ করা হয়।

পরবর্তীতে, এই ‘কিলো ফ্লাইট” এর অধিনায়ক হিসেবে অপারেশন পরিচালনা করেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। নবগঠিত এ বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যগণ অপর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেও তিনটি সাধারণ বিমান আর হেলিকপ্টারকে রূপান্তরিত করেন যুদ্ধবিমানে । এরপর ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে অটার বিমানের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি ডিপোর ওপর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সফল বিমান অভিযান পরিচালনা করেন। উড্ডয়নের সাথে সম্পৃক্ত কোনো প্রকার প্রযুক্তি ছাড়াই শুধুমাত্র দিক নির্ধারক কম্পাস এবং উচ্চতামাপক যন্ত্র অলটিমিটারের সাহায্যে ‘কিলো ফ্লাইট’ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ৫০টিরও অধিক সফল বিমান অভিযান পরিচালনা করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১,১৩৬ জন সদস্য প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ‘কিলো ফ্লাইট’এর অসামান্য অবদান ও বীরত্বপূর্ণ কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১ জন সদস্যকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ০৬ জনকে ‘বীর উত্তম’, ১ জনকে ‘বীর বিক্রম’এবং ১৫ জনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

ইএ/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভূমিকম্পের সময় চলছিল শাকিব খানের শুটিং Nov 21, 2025
img
পুরান ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত : রিজওয়ানা Nov 21, 2025
img
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অসহায় নারীরা মাসে সম্মানী পাবেন : দিপু ভূইয়া Nov 21, 2025
img

অ্যাটর্নি জেনারেল

গণহত্যার দায়ে পৃথিবীর যে কোনো আদালত শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করবে Nov 21, 2025
img
সেনাকুঞ্জে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ Nov 21, 2025
img
সঞ্জয়ের সব সম্পত্তিই আমার: প্রিয়া সচদেব Nov 21, 2025
img
পদোন্নতি জটিলতা দূর করতে শিক্ষা ক্যাডার প্রভাষক পরিষদের ৮ দাবি প্রস্তাব Nov 21, 2025
img
নোবেল নিতে দেশ ছাড়লেই ‘পলাতক’ হিসেবে গণ্য হবেন মাচাদো Nov 21, 2025
img
যতদিন ইনসাফ কায়েম না হবে ততদিন সংগ্রাম চলবে : সাদিক কায়েম Nov 21, 2025
img
বিএনপি চেয়ারপারসন ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াত আমিরের সৌজন্য সাক্ষাৎ Nov 21, 2025
অভিষেক জুটিতে অজি দলে চমক Nov 21, 2025
জনতার ঢল গাজীপুরে—হুমায়ুন কবির খানের আহ্বানে আনন্দ র‍্যালি Nov 21, 2025
img
নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীকে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Nov 21, 2025
img
নিজের জন্যেও ছোট আনন্দ তৈরি করুন: রাশমিকা মান্দানা Nov 21, 2025
img
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরদের স্মরণ করলো সশস্ত্র বাহিনী Nov 21, 2025
img
'মিস ইউনিভার্স'-এর মঞ্চে ফাতিমার উত্তর মুগ্ধ করল বিশ্বকে Nov 21, 2025
img
নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের পথে যাত্রা করবো : প্রধান উপদেষ্টা Nov 21, 2025
img
ভূমিকম্পে হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক Nov 21, 2025
img
সিরিজ বাঁচানো ম্যাচে পন্তের নেতৃত্বের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখছেন পন্টিং Nov 21, 2025
৩০০ আসনে ১৫০০ ফরম বিক্রি এনসিপির Nov 21, 2025