প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানার ঠিক আগে কিছু পোকামাকড় ও পশুপাখি অস্বাভাবিক আচরণ করে, এমন তথ্য বহুদিন ধরেই প্রচলিত। কখনো কুকুর অকারণে ঘেউ ঘেউ করে, ব্যাঙ পুকুর থেকে লাফিয়ে উঠে আসে, আবার গরু দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ইতিহাসেও এর উল্লেখ আছে।
অস্বাভাবিক প্রাণী আচরণের ঐতিহাসিক প্রমাণ
১৯৭৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চীনের হাইচেং শহরে ৭.৩ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের কয়েক সপ্তাহ আগে প্রচণ্ড ঠান্ডায়ও বহু সাপ গর্ত থেকে শীতকালীন আশ্রয় ছেড়ে বের হয়ে আসে। সরীসৃপদের এ আচরণ বিশ্লেষণ করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কয়েক ঘণ্টা আগেই পুরো শহর খালি করে ফেলেছিল—যা পরবর্তীতে হাজারো মানুষের জীবন রক্ষা করে।
প্রাণীরা কি সত্যিই আগাম সংকেত পায়? ২০১৩ সালের গবেষণা
২০১৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানীরা একটি ভূমিকম্প চ্যুতি রেখার কাছাকাছি বাস করা লাল কাঠ পিঁপড়াদের আচরণ ভিডিওতে ধারণ করেন। দেখা যায়—
ভূমিকম্পের আগে তাদের দৈনন্দিন আচরণ বদলে যায়,
রাতে বেশি সক্রিয় হলেও দিনে অস্বাভাবিকভাবে স্থির থাকে।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব অ্যানিমেল বিহেভিয়ার ও ইউনিভার্সিটি অব কনস্টানজের গবেষকেরা দাবি করেন, ভূমিকম্পের আগে খামারের প্রাণীদের আচরণেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। যদিও এসব দাবি এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়।
যেভাবে গবেষণা করা হয়
গবেষক মার্টিন উইকেলস্কির নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা ২০১৬–১৭ সালে ইতালির উত্তরাঞ্চলের ভূমিকম্পপ্রবণ একটি খামারে বায়োলগার ও জিপিএস সেন্সর ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করেন।
গবেষণায় ছয়টি গরু, পাঁচটি ভেড়া ও দুটি কুকুরকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
চার মাসে ১৮ হাজারের বেশি কম্পন রেকর্ড হয়, যার একটি ছিল ৬.৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প।
প্রতি সেকেন্ডে ৪৮ বার প্রাণীর নড়াচড়া রেকর্ড করার মতো সংবেদনশীল যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
এই গবেষণার ফলাফল ইথোলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
ভূমিকম্পের আগে প্রাণীর আচরণে যে পরিবর্তন দেখা যায়
পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে দেখা গেছে—
সব প্রাণীকে একসঙ্গে আবদ্ধ স্থানে রাখলে ৩.৮ মাত্রা বা তার বেশি ভূমিকম্পের আগে তাদের আচরণ স্পষ্টভাবে বদলে যায়।
খোলা চারণভূমিতে এ ধরনের পরিবর্তন তেমনভাবে দেখা যায় না।
আচরণের প্রবাহ ছিল—
প্রথমে কুকুরের ডাক বেড়ে যাওয়া,
তারপর গরুর অস্থিরতা,
সবশেষে ভেড়ার আচরণ পরিবর্তন।
গবেষকদের মতে, আবদ্ধ পরিবেশে প্রাণীরা চাপ বেশি অনুভব করে, যার ফলে সংকেতের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হয়।
প্রাণীরা কী সংকেত অনুভব করতে পারে?
বিজ্ঞানীদের অনুমান, ভূমিকম্পের আগে কোনো অদৃশ্য সংকেত—সম্ভবত মাটি থেকে নিঃসৃত খনিজজাত আয়ন—বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে—
ভূকম্পনের সময় শিলা থেকে খনিজ পদার্থ ভেঙে আয়ন নির্গত হয়,
প্রাণীরা এই পরিবর্তনশীল পরিবেশগত সংকেত অনুভব করে অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ করে।
এ ছাড়া প্রাণীদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে তথ্য আদান–প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে টিকে থাকার দক্ষতা বাড়ায়।
বিভিন্ন গবেষণায় বারবার দেখা গেছে—ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে প্রাণীরা অস্বাভাবিক আচরণ করে। যদিও এটি এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পূর্ণ প্রমাণিত নয়, তবুও গবেষকেরা মনে করেন—প্রাণীর আচরণ বিশ্লেষণ ভূমিকম্প পূর্বাভাসে ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এসএন