সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেছেন, বিভিন্ন সময় সরকারকে বলতে শোনা যায় যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নাকি অভূতপূর্ব স্বাধীনতা ভোগ করছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা নেই তা বলছি না; তবে সেটার মাত্রা আসলে কতটা, সেটাই প্রশ্ন।
শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে মাসুদ কামাল এসব কথা বলেন।
মাসুদ কামাল বলেন, কোনো সরকার যখন মিডিয়ার স্বাধীন সংবাদপ্রকাশ বা মতপ্রকাশে আপত্তি জানায়, তখন সেটা সাধারণত সমালোচনা সহ্য করতে না পারার কারণেই করা হয়।
সাধারণ নাগরিকের সমালোচনাও বিভিন্ন সময় ভয়-ভীতি দিয়ে দমন করার চেষ্টা করা হয়—এটাও নতুন কিছু নয়।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর ৮ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র এক মাস পর ১১ সেপ্টেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন।
আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’
মাসুদ কামাল বলেন, ড. ইউনূসের ভাষণের পর অনেকেই সত্যিই মন খুলে সমালোচনা করেছেন, আমি নিজেও করেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে সমালোচনা থেকে সরকারের কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে কি? তার মূল্যায়ন মোটেই না। সরকার সমালোচনা থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি।
তিনি বলেন, একসময় আমি মজা করে বলেছিলাম ড. ইউনূস হয়তো ভাষণে বলেছেন ‘মন খুলে সমালোচনা করুন’ তবে মনে মনে হয়তো বলেছেন, ‘যাই বলুন, কানে তুলব না’। বাস্তবেও তাই মনে হয়েছে।
মাসুদ কামাল বলেন, চলতি বছরের ২ মে প্রেসসচিব শফিকুল আলম চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক আলোচনায় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের সাংবাদিকতা নাকি ‘স্মরণকালের সেরা সময়’ পার করছে। সাংবাদিকরা নাকি এখন ‘মন খুলে কথা বলতে পারছেন’। কিন্তু আসলেই কি তাই।
আমার কাছে মনে হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি এর বিপরীত।
গুগলের সাম্প্রতিক প্রকাশনা:
মাসুদ কামাল বলেন, দুই দিন আগে গুগল তাদের নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গুগল বিশেষ করে ইউটিউবে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ ভিডিও অপসারণ করে থাকে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আপলোড হওয়া ভিডিওর মধ্যে ৬ লাখ ২১ হাজার ৬৫৫টি ভিডিও তাদের নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণে সরানো হয়েছে, যেগুলো হয়তো চৌর্যবৃত্তি, মানহানি বা অনৈতিক কনটেন্ট ছিল। কিন্তু এর বাইরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নিজ উদ্যোগে ২৭৯টি ভিডিও ও কনটেন্ট অপসারণের অনুরোধ করেছে। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল সরকারের সমালোচনামূলক কনটেন্ট, যেগুলো গুগল সরায়নি কারণ গুগলের মতে সমালোচনা অপরাধ নয়। তারা এসব ভিডিওতে মিথ্যা বা নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রমাণ পায়নি।
মাসুদ কামাল প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে সরকার কেন এই ভিডিওগুলো সরাতে চাইল? সরকার সমালোচনা সহ্য করতে পারছে না বলেই এসব অনুরোধ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অনুরোধ পাঠিয়েছে বিটিআরসি, যা সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান।
মাসুদ কামাল আরো বলেন, সরকার ভালোভাবেই জানে যে গুগল প্রতি ছয় মাসে এসব অনুরোধের তালিকা প্রকাশ করে। তবু কেন এমন অনুরোধ পাঠানো হলো? এ থেকেই প্রমাণ হয় ড. ইউনূসের ‘সমালোচনা গ্রহণ করার’ ঘোষণা বাস্তবে কার্যকর হয়নি।
মাসুদ কামাল মনে করেন, ছোটবেলায় একটা প্রবাদ ছিল, কানাকে কানা বলো না, খোরাকে খোড়া বলো না, এতে তারা কষ্ট পায়। সরকার যেসব সমালোচনাকে সরাতে বলছে, সম্ভবত সেগুলো সত্যের কাছাকাছি বলেই তাদের গায়ে লেগেছে।
তিনি আরো বলেন, সরকার জানত, প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ দিলে গুগল এগুলো সরাবে না। ঘটেছেও তাই, গুগল অধিকাংশ অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছে।
প্রেস সচিবের দাবির বিরোধিতা করে মাসুদ কামাল বলেন, প্রেসসচিব যতই বলুন যে দেশের গণমাধ্যম এখন ‘সেরা সময়’ পার করছে তবে বাস্তবে যারা মিডিয়ায় কাজ করেন, চাকরি হারিয়েছেন, কিংবা চাপের মুখে সংবাদ প্রকাশ করেন তারা এ কথার সঙ্গে একমত হতে পারেন না।
মাসুদ কামাল বলেন, বাংলাদেশের পত্রিকা-টেলিভিশনগুলো সরকারের কোনো সমালোচনা করে না। শুধু স্তুতি আর স্তুতি। সরকার কি সত্যিই এত ভালো করছে? আমার মনে হয় না।
আইকে/টিএ