প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বিধ্বংসী আঘাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভূমিকম্প। কোনো আগাম পূর্বাভাস ছাড়া এই বিপর্যয় মুহূর্তেই সবকিছু তছনছ করে দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় এ নিয়ে জনগণের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। গত ২১ নভেম্বর রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদীর মাধবদীতে, যা এই অঞ্চলের জন্য একটি নতুন উদ্বেগের কারণ।
প্রাকৃতিক এই বিধ্বংসী আঘাতের হাত থেকে বাঁচার কোনো আগাম উপায় ছিল না এতদিন। কিন্তু প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে সেই পরিস্থিতি বদলাতে চলেছে। এখন আপনার হাতের স্মার্টফোনটিই হয়ে উঠতে পারে জীবনরক্ষাকারী প্রথম ঢাল!
ভূমিকম্প আঘাত হানার কয়েক সেকেন্ড আগেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা আপনার ফোনে পৌঁছে যেতে পারে, যা আপনাকে আত্মরক্ষার জন্য মহামূল্যবান সময় দেবে। গুগল এবং কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্মার্টফোনের অন্তর্নির্মিত সেন্সর ব্যবহার করে এই ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ চালু করেছে।
কীভাবে কাজ করে আপনার স্মার্টফোন?
গুগলের এই বিশেষ ব্যবস্থাটি ‘অ্যান্ড্রয়েড আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনকে একটি ছোট ‘সিসমোমিটার’ বা কম্পন মাপক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
১. সেন্সর ব্যবহার: প্রতিটি স্মার্টফোনের ভেতরেই অ্যাক্সিলোমিটার নামের ক্ষুদ্র সেন্সর থাকে, যা ফোনের নড়াচড়া বা মাটির কম্পন বুঝতে পারে।
২. P-তরঙ্গ শনাক্তকরণ: ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটি তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। দ্রুতগামী P-wave (প্রাথমিক তরঙ্গ) কম ক্ষতিকর, কিন্তু ধীরগামী S-wave (মাধ্যমিক তরঙ্গ) অনেক বেশি বিধ্বংসী। স্থির অবস্থায় থাকা বা চার্জে থাকা ফোনগুলো প্রথমে এই P-wave শনাক্ত করে।
৩. সার্ভারে তথ্য প্রেরণ: কোনো একটি এলাকার একাধিক ফোন একই সময়ে P-wave-এর মতো অস্বাভাবিক কম্পন শনাক্ত করলে, সেই সংকেতটি ফোনের লোকেশনসহ দ্রুত গুগলের ডেডিকেটেড সার্ভারে পাঠানো হয়।
৪. বিশ্লেষণ ও সতর্কবার্তা: গুগল সার্ভার এই বিপুল সংখ্যক তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ করে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এবং সম্ভাব্য মাত্রা নিশ্চিত করে। যেহেতু ইন্টারনেট সংকেত কম্পনের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে চলাচল করে, তাই গুরুতর কম্পন পৌঁছানোর কয়েক সেকেন্ড আগে আশপাশের ব্যবহারকারীদের ফোনে সতর্কবার্তা পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এই কয়েক সেকেন্ড সময়ই ব্যবহারকারীকে ‘ড্রপ, কভার এবং হোল্ড অন’ (নুইয়ে পড়ুন, আশ্রয় নিন এবং ধরে রাখুন) নীতি মেনে নিজেকে সুরক্ষিত করার মহামূল্যবান সুযোগ দেয়।
যে ধরনের সতর্কবার্তা পাবেন
ভূমিকম্পের সম্ভাব্য তীব্রতা অনুযায়ী গুগল দুই ধরনের সতর্কতা পাঠায়:
Be Aware Alert (সচেতনতামূলক সতর্কতা): হালকা কম্পনের পূর্বাভাস পেলে এটি নোটিফিকেশন আকারে আসে।
Take Action Alert (ব্যবস্থা নেয়ার সতর্কতা): যখন মাঝারি থেকে তীব্র কম্পনের আশঙ্কা থাকে, তখন এটি পুরো স্ক্রিন জুড়ে আসে এবং উচ্চশব্দে বাজতে থাকে (এমনকি ফোন সাইলেন্ট বা ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ মোডে থাকলেও)। এতে নিরাপদ থাকার জন্য প্রাথমিক নির্দেশনা দেয়া থাকে।
যেভাবে আপনার ফোনে অ্যালার্ট চালু করবেন
এই সুবিধাটি বিশ্বজুড়ে দুই বিলিয়নেরও বেশি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীর জন্য উপলব্ধ এবং সাধারণত এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু থাকে। তবে নিশ্চিত হতে এবং যদি বন্ধ থাকে তবে চালু করতে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
১. ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করুন: আপনার ফোনে অবশ্যই Wi-Fi বা মোবাইল ডেটা চালু থাকতে হবে। পাশাপাশি, লোকেশন সার্ভিস অন রাখা বাধ্যতামূলক।
২. সেটিংস থেকে চালু করুন:
আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোনের Settings অ্যাপটি খুলুন।
সার্চ বারে অথবা স্ক্রল করে ‘Safety & emergency’ অপশনটি খুঁজুন এবং তাতে প্রবেশ করুন।
(কিছু ফোনে এই অপশনটি না থাকলে: Location > Advanced > Earthquake Alerts এই পথে যান)
‘Earthquake alerts’ অপশনটি নির্বাচন করুন।
পাশের টগল সুইচটি টিপে ‘Earthquake alerts’ অপশনটি ON করে দিন।
আপনি চাইলে সেটিংসে দেয়া ‘ডেমো’ বাটনে ক্লিক করে সতর্কবার্তা কেমন দেখাবে এবং কেমন শব্দ হবে, তা দেখে নিতে পারেন।
বাংলাদেশে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে?
হ্যাঁ! গুগল ২০২৪ সালের জুন থেকে বাংলাদেশসহ ১২০টির বেশি দেশে এই ফিচার চালু করেছে। বাংলাদেশে এটি সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।
এই প্রযুক্তি আপনাকে ভূমিকম্পের মতো বিধ্বংসী আঘাত থেকে রক্ষা করতে পুরোপুরি সক্ষম না হলেও, কয়েক সেকেন্ডের এই আগাম সতর্কতা আপনার জীবন রক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।
আরপি/টিকে