‘আমার বয়স ৭৮ বছর। জীবনে প্রথমবার এমন ভুল হয়েছে। আমি নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে অবমাননার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এভাবেই অনুশোচনা প্রকাশ করেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফজলুর রহমান।
সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন টকশোতে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে আজ (সোমবার) বেলা ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হন বিএনপির এই নেতা। পরে ১১টা ৪০ মিনিট থেকে শুরু হয় শুনানি।
শুরুতেই ফজলুর রহমানের বসার অনুমতি চান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। কারণ আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলের অনুমতি পেয়ে ডিফেন্স আইনজীবীদের সোফায় বসেন এই বিএনপি নেতা।
এরপর ফজলুর রহমানের পক্ষে শুনানি শুরু করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি বলেন, নিজের বক্তব্যের জন্য গভীরভাবে অনুতপ্ত ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন ফজলুর রহমান। একপর্যায়ে প্রসিকিউশনকে শুনতে চান ট্রাইব্যুনাল।
এ সময় প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, গত ২৩ নভেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের একটি টকশোতে অতিথি হয়ে যান ফজলুর রহমান। টকশোতে ট্রাইব্যুনালকে স্বীকার করেন না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এ সময় তার বক্তব্যের কথাগুলো পড়ে শোনানো হয়।
এরপর ফজলুর রহমানের বক্তব্য জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। তার উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি বলেন, আপনি কি এ কথাগুলো বলেছেন। তখন ফজলুর রহমানের বক্তব্য তুলে ধরতে চান আইনজীবী কাজল। তবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ফজলুর রহমানকে শোনা দরকার। ওনি এখানে উপস্থিত রয়েছেন। ওনি যদি বলেন বলিনি। তাহলে বিবেচনা করবো। আর যদি বলেন, আরও বলে যাবো। তাহলে আরেক ধরনের বিবেচনা করা হবে।
এ সময় ফজলুর রহমানের একটি আবেদন পড়ে শোনান রুহুল কুদ্দুস কাজল। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওনাকে আমরা চিনি। ওনি একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওনি যা বলেছেন, আরও বলবেন কিনা। তিনি যে কথা বলেছেন, এসব কথা দেশে নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে।
একপর্যায়ে ফজলুর রহমানের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনি কি এই কথাগুলো বলেছেন। জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, মাই লর্ড, আমি এভাবে বলিনি।
তখন রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ট্রাইব্যুনালের ওপর ফজলুর রহমানের পুরোপুরি বিশ্বাস রয়েছে। এ ধরনের মন্তব্যের জন্য তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চান। তিনি সত্যিই এ ঘটনার জন্য অনুতপ্ত।
এ সময় ফজলুর রহমানের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সীমারেখা থাকা দরকার। এই ট্রাইব্যুনাল কোনো নির্দিষ্ট সময়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ যেকোনো সময় সংঘটিত হতে পারে। তাই এসব কথা বলা বেমানান। আপনার মতো লোকের কাছে এমন বক্তব্য আশা করি না।
একইসঙ্গে চেয়ারম্যান গোলাম মর্তূজা মজুমদার বলেন, আমার পরিবারেও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। রাতে রুম ছেড়ে দিয়েছি। খাইয়েছি। কোন দিকে যেতে হবে বলে দিয়েছি। আমি কি মুক্তিযোদ্ধা নই। আপনাদের অবস্থান সুপিরিয়র।
মুক্তিযুদ্ধকে সহজে আনবেন না। জুডিশিয়ারিকে আপনারা গাইড করবেন। বিচারিক কাজে পরামর্শ দেবেন। কারণ আপনাদের কথা সবাই শুনবে।
এ সময় বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, গত ১৭ বছর আপনি অন্যায়-অবিচার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। হঠাৎ এমন ইউটার্ন নিলেন কেন।
জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, আল্লাহর পরই আপনাদের প্রতি আমার সম্মান। আমার জীবনে কখনও এমন ভুল হয়নি। এটা স্লিপ অব টাং হয়ে যেতে পারে। আমার বয়স ৭৮ বছর। জীবনে প্রথমবার এমন ভুল হয়েছে। আমি নিঃশর্ত ক্ষমা চাই। তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ঠিক আছে। আপনি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন।
টেলিভিশনের টকশোতে যা কিছু বলতে চাই না, তাও মুখ দিয়ে বের করে ফেলা হয় উল্লেখ করে পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই সম্মান পাওয়া যায় না। এরপরও বলতে হয়, মুক্তিযোদ্ধারা গত ৯ মাস কী করেছে। কচুবনে দিনের পর দিন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ফজলুর রহমান কোর্টকে ম্যালাইন করার জন্য এরকম কথা বলবেন, এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন।
জুডিশিয়ারি যদি ফ্যাংশন না করে, তাহলে তো দেশ বর্বর হয়ে যাবে। সবশেষ ফজলুর রহমানের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, অল দ্য বেস্ট। আরও অনেক দিন বেঁচে থাকেন।
এর আগে, ৩০ নভেম্বর আদালত অবমাননার এ অভিযোগের ব্যাখ্যা শুনতে ফজলুর রহমানকে তলব করেন ট্রাইব্যুনাল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ সশরীরে হাজির হন বিএনপির এই নেতা। তবে লিখিতভাবে আগেই নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার নিয়ে চ্যালেঞ্জ, আদালতের নিরপেক্ষতায় হস্তক্ষেপকারী, ‘অভ্যন্তরীণ বন্দোবস্ত’ রয়েছে বলে দাবি ও প্রসিকিউশন প্রসঙ্গে অবমাননাকর মন্তব্য; এই তিনটি কারণে ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে প্রসিকিউশন। এ নিয়ে ২৬ নভেম্বর প্রথম শুনানি হয়। ৩০ নভেম্বর অবশিষ্ট শুনানি শেষে ব্যাখ্যা জানতে বিএনপির এই নেতাকে তলব করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ২৩ নভেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ‘মুক্তবাক : রাজনীতির তর্ক-বিতর্ক’ টকশোতে অতিথি হয়ে যান ফজলুর রহমান।
টকশোর একপর্যায়ে শেখ হাসিনার রায় প্রসঙ্গ আসতেই নানান কথা বলেন তিনি। ৪৯ মিনিটের টকশোটি পেনড্রাইভের মাধ্যমে এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনালেও ফজলুর রহমানের বক্তব্যের কিছু অংশ বাজিয়ে শোনানো হয়।
আইকে/এসএন