২০২৫ সাল ছিল পরিবর্তনের বছর, কিন্তু ২০২৬ হতে যাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতির এক চরম সন্ধিক্ষণ বা ‘হিঞ্জ ইয়ার’। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং সিএনএনের বৈশ্বিক বিষয়ক বিশ্লেষক ব্রেট এইচ ম্যাকগার্কের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণ এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। জো বাইডেনের বিদায় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের পর বিশ্বজুড়ে যে অস্থিরতা ও নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে, তার চূড়ান্ত রূপ দেখা যেতে পারে আগামী বছর।
বর্তমানে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার মাদুরো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যে অনড় অবস্থান নিয়েছেন, তাকে বলা হচ্ছে ‘ট্রাম্প করোলারি’। এটি মূলত ১৮২৩ সালের বিখ্যাত ‘মনরো ডকট্রিন’-এর একটি আধুনিক ও কঠোর সংস্করণ। ২০২৬ সালে যদি মাদুরো ক্ষমতায় টিকে থাকেন, তবে ট্রাম্পের এই প্রভাব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আর যদি পতন ঘটে, তবে পশ্চিম গোলার্ধে মার্কিন আধিপত্য এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
ইউক্রেন ও তাইওয়ান সংঘাত নতুন মোড় নিয়ে ২০২৬ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ পঞ্চম বছরে পদার্পণ করবে। পুতিন যখন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের মাধ্যমে ইউক্রেনের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করছেন, ট্রাম্প তখন একটি শান্তি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ করতে চান, যেখানে ইউক্রেনকে হয়তো তার ভূখণ্ড ছাড়তে হতে পারে। অন্যদিকে, তাইওয়ান ঘিরে দানা বাঁধছে বড় সংকট। ২০২৭ সালের মধ্যে চীন সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাইওয়ান সংকটের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ট্রাম্পের ১১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনকে কোথায় নিয়ে যায়, এখন সেটাই দেখার বিষয়।
ইসরায়েল ও ইরানের ভাগ্য নির্ধারণ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ২০২৬ সাল হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অক্টোবরের মধ্যে ইসরায়েলে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। নেতানিয়াহুর বর্তমান উগ্র ডানপন্থী জোট যদি ক্ষমতায় টিকে থাকে, তবে আরব দেশগুলোর সাথে শান্তি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, ইরান বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তার প্রক্সি বাহিনী-হিজবুল্লাহ, হামাস বিধ্বস্ত, অর্থনীতি বিপর্যস্ত এবং সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির উত্তরসূরি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। আগামী বছর ইরানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বা বড় কোনো সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
সন্ত্রাসবাদ ও এআই বিপ্লব ম্যাকগার্ক সতর্ক করেছেন, বিশ্বশক্তির লড়াইয়ের আড়ালে আইএস ও আল-কায়েদা আবারও শক্তিশালী হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্র তারই প্রমাণ। পাশাপাশি প্রযুক্তি বিশ্বে ‘এআই রেস’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লড়াই এখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। চীনের নতুন এআই মডেল ‘ডিপসিক’ মার্কিন আধিপত্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ২০২৬ সালে এই প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বই নির্ধারণ করবে কে হবে আগামীর বিশ্বনেতা।
সব মিলিয়ে, ২০২৬ সাল হতে যাচ্ছে এমন একটি বছর যা নির্ধারণ করে দেবে আগামী এক দশকের বিশ্বব্যবস্থা। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং রাশিয়া-চীন-ইরান-উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান অক্ষশক্তি বিশ্বকে এক নতুন মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
টিজে/টিকে