আমরা ছুটছিলাম। অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো। ঘৃণা নিয়ে, বিদ্বেষ নিয়ে, অনুভূতির ছেলেখেলা নিয়ে, উপরে ওঠার প্রবল তাড়া নিয়ে ঠুলি-আঁটা চোখে আমরা ভীষণ গতিতে এগিয়ে যেতে মগ্ন থেকেছি। প্রত্যেকে নিজের নিজের কোটরে গলা ডুবিয়েছিলাম, যাতে আত্মবিশ্লেষণের জন্য একচিলতে জায়গাও ফাঁকা না থাকে। করোনাভাইরাস সেই দুর্বার গতিকে রুদ্ধ করল।
আমরা কী জানতাম না এমন কিছু হতে পারে? আসলে আমরা বরাবর আশঙ্কিত হয়ে রয়েছি। আমরা জানি, কোনো তীব্র সংকট যখন-তখন তার আগ্রাসন দিয়ে আমাদের ‘অর্জিত’ গতিকে থামিয়ে দিতে পারে। তাই তো আমাদের এত তাড়া। শুধু সংকট যে এমন বিশ্বব্যাপী হবে, এমন চিন্তা মনে আসেনি। সবাই প্রতিনিয়ত ভেবেছি, যা-ই হোক, আমার কিছু হতে দেয়া যাবে না। আমার মগ্নচৈতন্য যেন বিঘ্নিত না হয়।
এই ভাবনার মধ্যে সম্মিলিত থাকার যাবতীয় উপাদান থাকা সত্ত্বেও স্বার্থের আরোপিত নেশা সে উপাদানকে কাজে লাগাতে দেয় না। জীবনযাত্রায় গতানুগতিকতার অবসরকে কাজে লাগিয়ে জীবনবোধকে হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা হারাতে হারাতে আজ আমরা আরেকবার মৃত্যুপথযাত্রী। আদমশুমারির মানুষের অস্তিত্ব যেমন সংখ্যায়, আজ আমরা তেমন করে সংখ্যারাশিতে উত্তীর্ণ হয়েছি। ছয় জন থেকে বারো হাজারে, একশো থেকে দশ লাখে বিপদসংকুল মানুষ তার স্থিতাবস্থা চুরমার হয়ে যাওয়াকে প্রতিফলিত করছে।
বেলারুশের নোবেলজয়ী সাংবাদিক তথা সাহিত্যিক শ্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচ ১৯৮৬-তে চের্নোবিলের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লাণ্টে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের অব্যবহিত পর থেকে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নেন এবং তার উপর ভিত্তি করে চের্নোবিলস্কা মোলিতভা (১৯৯৭) শিরোনামে একটি বই লেখেন (ইংরেজি ভাষান্তর- Chernobyl Prayer/Voices from Chernobyl, ২০০৫/২০১৬)। সেই বইয়ের প্রত্যেক পাতায় আঁকা আছে মানুষের স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার মর্মস্পর্শী আলেখ্য। সন্তানহারা এক পিতা সাক্ষাৎকারে বলেন, “দশ বছর আগের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আমার পরবর্তী জীবনের প্রত্যেক দিনের ভূমিকা বেঁধে দিয়ে গিয়েছে। আমার আর মনে পড়ে না, ২৬ শে এপ্রিল ১৯৮৬-র আগে আমার জীবনে কোনো আনন্দঘন মুহূর্ত এসেছিল কিনা। শুধু মনে পড়ে, আমার একটা অত্যন্ত সাধারণ জীবন ছিল। অসাধারণ কিছু ঘটার কথা কল্পনাতেও আসেনি। প্রথমদিক মধ্যরাতে আমরা একসঙ্গে দূর থেকে বিস্ফোরণের আগুন দেখছিলাম। আমাদের প্রিপিয়াতের আকাশ সেই রাতে ঝলসে উঠেছিল। তারপরের দিন থেকে একটা গন্ধ নাকে লেগে থাকল। সেই ঝলসানো আকাশ আর অদ্ভুত পোড়া গন্ধটাই জীবনে প্রথম অসাধারণকে আমার কাছে এনে দিল। ওই দৃশ্য আর গন্ধ দশ বছর ধরে একদিনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। কোনোদিন যাবে না।”
বিশ্বজোড়া ত্র্যস্ত আবহে করোনা এমনি করে কত সাধারণ জীবনকে ‘অসাধারণ’ করে দিয়ে চলে যাবে। ইতিমধ্যেই করে দিয়ে গেছে। একবিংশ শতকের মানুষের মুঠোয় থাকা বিশ্বে রোজ মৃত মানুষের সংখ্যা গুনছি আমরা। আপ্রাণ চেষ্টা চলছে, অনেক বেঁচে থাকা মানুষ সাধ্যমতো কিংবা সাধ্যের বাইরে গিয়ে এক অসম লড়াই লড়ে যাচ্ছেন। কয়েক প্রজন্ম পরে এই চরম বর্তমান আবেগমথিত অতীতের জায়গা নেবে।
ইতিহাস বলবে, আক্রান্ত সংখ্যা এত, এত মানুষ সুস্থ হয়েছিলেন, আর এতজন মারা গিয়েছিলেন। এখন যেভাবে ইতিহাস পড়ি সাল-সংখ্যায় জড়িয়ে, একক মানুষের অজস্র গাথা হারিয়ে যায় কোন্ সমুদ্রে। সে সমুদ্র মন্থন করার আয়োজন দেবকুল আর করবেন কিনা জানা নেই। তবে এটুকু জানি, মারণ ভাইরাস তার ঐতিহাসিক তাণ্ডবের জোরে একসঙ্গে ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞানের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।
চের্নোবিলের ঘটনার অভিঘাতে অনেক দমকল কর্মী প্রাণ হারান। প্রাথমিক অবস্থায়, কোনো সুরক্ষা ছাড়াই আগুন নেভাতে তাঁরা তৎপর হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন না, উন্মুক্ত শরীরে মারাত্মক বিষক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। কেউ একদিনের মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যান। কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য মস্কো নিয়ে আসা হয়। এক দমকলকর্মীর স্ত্রী অতীত রোমন্থন করার সময় বলছেন, “কীসের কথা বলব? মৃত্যুর কথা নাকি আমার ভালোবাসার কথা। আজ তো আমার কাছে দুইই সমান। ভালোবাসাকে আমি মৃত্যুর স্মৃতি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি।” তাঁর স্বামী মস্কোর হাসপাতালে অস্থিসার দেহে যে কদিন বেঁচে ছিলেন, ল্যুদমিলা উদভ্রান্তের মতো বারবার ছুটে গেছেন বিছানার পাশে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে তাঁকে বারবার সতর্ক করা হয়েছিল, তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সে এভাবে নিজের শরীরকেও রেডিয়েশনের সামনে উন্মুক্ত করে ঠিক করছে না। তাঁকে থামানো যায়নি। দলা পাকানো মৃতদেহ কফিনবন্দী করে কফিনটি দস্তা দিয়ে ঝালাই করে দেয়া হচ্ছে দেখে ল্যুদমিলা প্রথমবার কেঁদে উঠেছিলেন। তিনি কাউকে দোষ দেন না, কেবল বলেন, “এই তো আমার প্রেমগাথা।” জীবনটা ঠিকঠাক চলার সময় আমরা একটু দূর অবধি ভেবে নিয়ে নিজেকে বলি, আমার মৃত্যুও হবে সর্বাঙ্গসুন্দর। কিন্তু হয় না। একটিমাত্র মৃত্যুর শোকে বিহ্বল হতে হতে হঠাৎ দেখি চারপাশে বিপুল সংখ্যক মানুষ হাঁটছে মৃত্যু মিছিলে। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া দেহে সে মানুষ মৃত্যুযাত্রায় হয়তো প্রথমবার আরাম পায়।
মানুষের আত্মমগ্ন থাকার রাস্তায় করোনা এখন এক ভীষণ অন্তরায়ের নাম। গতিশীল জীবনযাত্রায় বিষণ্ণতার এই আচমকা আঘাত থেকে আমরা সবাই মুক্তি পাব না। চের্নোবিলের ঘটনার পর হাসপাতালের মৃতের সংখ্যা যখন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, তখন প্রিয়জনকে শেষবার দেখতে আসা মানুষ হাসপাতালেরই বাথরুমে ছুটে যেত। সবার সামনে আর ক’বার ঠিকরে আসা চোখের জল উজাড় করে দেয়া যায়? গোপনে কাঁদতে চাওয়া স্বজনের ভিড়ে বাথরুমের সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে যেত। আমাদের মধ্যেই কেউ কালকের প্রস্ফুটিত রোদমাখা আকাশ আর দেখতে পাব না। আমার আশপাশের কেউ ভোররাতে আর উঠবে না ফুল চুরি করতে।
তবু যাঁরা বেঁচে থাকবেন, যাঁরা পূর্ণিমার চাঁদ আরও অনেকবার দেখবেন, ফুল চুরি ছেড়ে একটি ফুলগাছ বসাবেন, সেই মৃত্যুঞ্জয়ীরা ভবিষ্যৎকে একটিবার অন্তত বলে যাবেন, চরম গতিতে এগিয়ে যাও, ক্ষতি নেই। কিন্তু অতর্কিতে কোনো বাধা এলে থামতেই হবে। স্কুলজীবনে এক শিক্ষক বলেছিলেন, “জীবনে সবাই এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা দেবে। আমি বলব, আগে কোথায় থামতে হবে শেখো।” আজ ক্ষণিকের জন্য থেমে গিয়ে পৃথিবীর শ্রান্তি ধুয়ে দিতে হবে সাধ্যমতো। এই গতিরোধ বিলাসিতার নয়, বাধ্যতার।
লেখক: তুলনামূলক সাহিত্যের গবেষক, বিশ্বভারতী