অ্যাঞ্জেলা মার্কেল: ধর্মযাজকের মেয়ে থেকে ইউরোপের রানী

অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। জার্মানের একজন সফল রাষ্ট্রনেতা ও জনপ্রিয় ইউরোপিয় রজনীতিবিদ। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেলই ইউরোপিয় ইউনিয়নের কার্যত নেতা। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মার্কেল। একই সঙ্গে তিনি উন্নত দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর অন্যতম সিনিয়র নেতা।

অ্যাঞ্জেলা মার্কেল নামে পরিচিত অ্যাঞ্জেলা কাসনার ১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই জার্মানির হামবুর্গ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন পূর্ব জার্মানির গির্জার একজন ধর্মযাজক। তৎকালীন জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের অন্তর্গত উত্তর বার্লিনের একটি গ্রামে বড় হয়েছেন মার্কেল।
ইউনিভার্সিটি অব লিপজিগ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে পড়েছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর পূর্বজার্মানির বিজ্ঞান একাডেমিতে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি সহপাঠী উলরিখ মার্কিলকে বিয়ে করেন। কিন্তু চার বছর যেতে না যেতেই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

১৯৮৯ সালের দিকে পূর্ব জার্মানিতে শুরু হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন। যার ফলে দুই জার্মানিকে পৃথককারী ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়ালের পতন ঘটে। ঠিক সেই সময়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন মার্কেল। ১৯৯০ সালে দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার পর তিনি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নে (সিডিইউ) যোগ দেন।

পরের বছরই তিনি চ্যান্সেলর হেলমুট কোলের মন্ত্রিসভার মহিলা ও যুব বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরে একই সরকারের পরিবেশ ও পরমাণু নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে হেলমুট কোল হেরে গেলে সিডিইউ পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। পরে ২০০০ সালে এই দলের প্রধান নেতা নির্বাচিত হন মার্কেল।

২০০৫ সালের নির্বাচনে তার দল সিডিইউ জয়লাভ করে এবং সোস্যাল ডেমোক্রেট পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। এ সরকারের চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন মার্কেল। আর তিনিই হলেন জার্মানির ইতিহাসে প্রথম নারী চ্যান্সেলর এবং ঐক্যবদ্ধ জার্মানির নেতৃত্বদানকারী প্রথম পূর্বজার্মানির নাগরিক।

চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে জার্মান রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এই সময়ের মধ্যেই ইউরোপের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানি নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। ফলস্বরূপ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে, ২০১৩ সালে তৃতীয় মেয়াদে ও সর্বশেষ ২০১৭ সালে চতুর্থ মেয়াদে জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন মার্কেল।

দীর্ঘ শাসনামলে ইউরোজোন সংকট ও ইউরোপের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, বৈশ্বিক জলবায়ূ সংকট মোকাবেলা এবং ইউরোপের অভিবাসী ও শরণার্থী সংকট সমাধানে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৭ সালে তিনি ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ সময় লিসবন চুক্তি এবং বার্লিন ঘোষণার মত ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখোগ্য ভূমিকা রাখেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সংকট ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে টিকে আছে বিশ্বের বৃহত্তম একক বাণিজ্যিক ব্লক ইউরোপিয় ইউনিয়ন। ইউরোপিয় ইউনিয়নের এই টিকে থাকার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন মার্কেল। এমনকি ২০১৬ সালে যখন ব্রিটেন ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ইইউ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়। ঠিক তখনই যেকোনো মূল্যে ইইউকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিশ্রুতি দেন মার্কেল।

তাই অনেকেই তাকে ইউরোপিয় ইউনিয়নের অন্যতম স্থপতি হিসেবে আখ্যা দেন। কেউ কেউ তাকে বলেন ‘জার্মানির রানি’। আবার কেউ কেউ তাকে ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ বলেও বর্ণনা করেন। ২০১৮ সালে ফোর্বস কর্তৃক নির্বাচিত বিশ্বের প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় রেকর্ড ১৪ বারের মত স্থান পেয়েছেন ইউরোপের অন্যতম পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ এঞ্জেলা মার্কেল।

২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃক পার্সন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মার্কেলকে ‘উদার পশ্চিমা বিশ্বের সর্বশেষ রক্ষক’ হিসেবে মন্তব্য করে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।

অ্যাঞ্জেলা মার্কেল সম্পর্কে সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেন, ‘তিনি হলেন মুক্ত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা’।

সম্প্রতি ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দেন মার্কেল। এরপর ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের প্রধান নির্বাচিত হন মার্কেলেরই পছন্দের প্রার্থী আনেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার। তবে দলের নেতৃত্ব ছাড়লেও ২০২১ সালে তার চতুর্থ মেয়াদ শেষ হবার আগ পর্যন্ত চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করে যাবেন ইউরোপের রানি মার্কেল।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হবিগঞ্জের ৪ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ২৯ প্রার্থী Dec 30, 2025
img
টাঙ্গাইলের ৮ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৬৫ প্রার্থী Dec 30, 2025
img
মাকে দেখতে হাসপাতালে তারেক রহমান Dec 30, 2025
img
যশোর-৪ আসনে ভোটের লড়াইয়ে বাবা-ছেলের আলাদা মনোনয়নপত্র দাখিল Dec 30, 2025
img
নির্বাচনে জয় পেলেন নায়িকা পলি Dec 30, 2025
img
কিশোরগঞ্জের ৬টি আসনে ৫৮ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল, ১১ জন স্বতন্ত্র Dec 30, 2025
img
যশোরে মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের দুই প্রার্থী Dec 30, 2025
img
সারজিসকে সমর্থন জানিয়ে পঞ্চগড়-১ আসন থেকে সরে দাঁড়ালেন জামায়াতের প্রার্থী Dec 30, 2025
img
নাটোরের ৪ আসনে ৩৪ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল Dec 29, 2025
img
নোয়াখালীতে ৬ আসনে ৬২ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল Dec 29, 2025
img
পুতিনের বাসভবন লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা ইউক্রেনের Dec 29, 2025
img
কুমিল্লা-১১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি প্রার্থী কামরুল হুদা Dec 29, 2025
img
শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন হান্নান মাসউদ Dec 29, 2025
img
নতুন ছক্কার রেকর্ড, গেইলকে টপকালেন তামিম Dec 29, 2025
img
বগুড়া-৭ আসনে খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়নপত্র দাখিল Dec 29, 2025
img
পিরোজপুর-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন মাসুদ সাঈদী Dec 29, 2025
img
জকসু নির্বাচন: ৬টি মেশিনে ভোট গণনা, হবে সরাসরি সম্প্রচার Dec 29, 2025
img
এই নির্বাচনে বিএনপি একা হয়ে পড়েছে : ডা. তাহের Dec 29, 2025
img
বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় ময়মনসিংহ-৬ আসনে জামায়াত নেতা বহিষ্কার Dec 29, 2025
img
তাসনিম জারার রহস্যময় পোস্ট Dec 29, 2025