ভিআইপি ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতার জোরেই সাহেদের কালো জগত!

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ তার অপরাধের সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রথমসারির রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। সেই সঙ্গে সামাজিক পরিমন্ডলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য তিনি সংবাদমাধ্যমেও প্রভাব বৃদ্ধি করেন। ঘনিষ্ট সংবাদকর্মীদের ব্যবহার করে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি পাওয়ার নেশায় মেতে উঠেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মো. সাহেদ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে অসংখ্য টকশোতে অংশ নিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১১ মার্চ থেকে ‘দৈনিক নতুন কাগজ’ নামে একটি সংবাদপত্রও বের করছেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আড়াল করতে মিডিয়ার পরিচয় তিনি ব্যবহার করতেন। আইনশৃংখলাবাহিনীর অনুসন্ধানেও এসব তথ্য উঠে এসেছে।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার বদরুজ্জামান জিল্লু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাহেদের উত্থানের নেপথ্যে গডফাদার হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিকের যোগসাজশ পাইনি। সাহেদ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিভিন্ন টকশোতে অংশ নিতেন। এছাড়া খবরের কাগজের মালিক হয়ে সেই পরিচয় ব্যবহার করে নানাভাবে প্রতারণা শুরু করেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাহেদ নিয়মিত সচিবালয়ে যাওয়া-আসা করতেন। সংবাদপত্র দেখিয়ে তিনি একটি প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডও সংগ্রহ করেছিলেন। বিশেষ নিরাপত্তা পাসের ব্যবস্থা করে তিনি বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন।

এছাড়া অপরাধ জগতে নিজের অবস্থান মজবুত করার জন্য রাজধানীর উত্তরা ও গুলশান এলাকার তালিকাভুক্ত অপরাধীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন সাহেদ। এসব চিহ্নিত অপরাধীদের নিজের পত্রিকায় চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করেন তিনি। এমনকি ভবিষ্যতে নামীদামী সাংবাদিকদের নিয়োগের মাধ্যমে পত্রিকাটির ভালো ইমেজ তৈরির পরিকল্পনাও ছিল সাহেদের।

তবে সাহেদের টার্গেটে ছিল দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। নানা উসিলায় সাহেদ সরকার ও প্রশাসনের ভিআইপি ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতার চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সফলও হন। এছাড়া সরকারি ও প্রশাসনিক বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে গিয়ে বিশেষ মুহুর্তের ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়াতেন সাহেদ। এতে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রভাব বাড়তে থাকে। এমনকি বিভিন্ন অপরাধের দায়মুক্তির জন্য তিনি এসব ব্যক্তিদের নামও ব্যবহার করতেন।

গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, কোভিড-১৯ টেস্টের রিপোর্ট জালিয়াতি, করোনা রোগীদের পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য টাকা নেয়া এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তি লঙ্ঘন করার মামলায় ১৬ জুলাই থেকে সাহেদের ১০ দিনের রিমান্ড শুরু হয়। এসময় ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদকালে এসব তথ্য দিয়েছেন মো. সাহেদ।

এদিকে গতকাল রোববার সাহেদের নামে থাকা অন্য চারটি জালিয়াতির মামলায় মোট ২৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এছাড়া উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজকে ২১ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, সাহেদ তার অপরাধ আড়াল করতে মিডিয়া ব্যবহার করেছে বলে আমি মনে করি না। বরং তিনি তার অপরাধের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সখ্যতাকে ব্যবহার করেছেন। কারণ সাহেদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই মামলা ছিল, কিন্তু প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তার করেনি। এতে কি বুঝা যায়?

সাংবাদিক কুদ্দুস আফ্রাদ আরও বলেন, একটি সংবাদপত্রের জন্য অনুমোদন পেতে গোয়েন্দা ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। প্রতারণার একাধিক মামলা থাকার পরও তার নামে পত্রিকার ছাড়পত্র কিভাবে দেয়া হলো?

সাহেদের নামে যত অভিযোগ

১৫ জুলাই ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাহেদকে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকেই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, চাকরিপ্রার্থী, চিকিৎসক ও আইনজীবীসহ অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং তারা সাহেদের নামে অভিযোগ দায়ের করছেন।

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একজন দাবি করেছেন যে, মাত্র সাত দিন রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় তার মাকে ভর্তি রাখার পর তাকে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

ওই ব্যক্তি জানান, তার মাকে ২ জুন ভোর ৪টার দিকে কোভিড-১৯ এর লক্ষণসহ রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির একদিন পর থেকেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, রোগীকে আইসিইউ’তে রাখতে হবে। আইসিইউ’তে দুদিন রাখার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মাকে আবার জেনারেল ওয়ার্ডে স্থানান্তর করে। ৮ জুন তারা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদের আড়াই লাখ টাকার বিল দেয়।

এদিকে অপর এক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তিনি পায়ে আঘাত পেয়ে রিজেন্ট হাসপাতালে মাত্র একদিন ছিলেন। এতেই তার বিল এসেছিল ৫০ হাজার টাকা। সিলেটের এই বাসিন্দা আরও জানান, আইসিইউতে না রেখেই তার কাছ থেকে আইসিইউ’র বিল নেয় রিজেন্ট হাসপাতাল।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, রিজেন্ট হাসপাতালে আসা রোগীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আইসিইউ বিল নেয়া হতো। কেউ যদি বিল পরিশোধ করতে অস্বীকার করতেন, তাহলে হাসপাতালের কর্মীরা রোগীদের স্বজনদের হুমকি-ধামকি দিতেন। কোনো কোনো সময় সাহেদ নিজেই রোগী ও তাদের স্বজনদের জীবননাশের হুমকি দিতেন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ২০ জুলাই সাহেদের ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে সাহেদ বিভিন্ন মানুষকে হুমকি-ধামকি দিতেন। যা সাহেদ নিজেই স্বীকার করেছেন।

তবে সাহেদের বিরুদ্ধে সব থেকে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ হলো- করোনা পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট দেয়া। বিষয়টি টের পেয়ে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায় এবং অভিযোগের সত্যতা মেলে।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৭ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে করোনা টেস্টের প্রায় ১৫ হাজার ভুয়া রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। আর এভাবে প্রতারক সাহেদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, আমরা ২২ জুলাই তদন্ত সেলটির ফোন নম্বর বন্ধ করে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত সাহেদের বিরুদ্ধে আমরা ১৩৯ জনের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছি। সাহেদের প্রতারণার শিকার এসব ব্যক্তিরা এতদিন সাহেদের ভয়ে মুখ খুলেননি।

 

টাইমস/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
অবশেষে পুরোনো ছন্দে ফিরছে শুভ-সোহিনীর ‘লহু’! Jul 07, 2025
img
৪ দশকের শাসনকাল আরও বাড়ানোর সুযোগ উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনির Jul 07, 2025
img
গণহত্যা মামলায় শেখ হাসিনাকে অব্যাহতির আবেদন স্টেট ডিফেন্সের Jul 07, 2025
img
খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস Jul 07, 2025
img
‘আমার প্রিয় সাংবাদিক কোথায়’, ট্রল করলেন গিল Jul 07, 2025
img
অস্ত্র মামলায় ২ দিনের রিমান্ডে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক Jul 07, 2025
img
ঐকমত্য কমিশন কারো ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে না: আলী রীয়াজ Jul 07, 2025
img
যুদ্ধবিরতি নিয়ে এই সপ্তাহেই একটি চুক্তি হতে পারে: ট্রাম্প Jul 07, 2025
img
সারা দেশে আগামী ২৪ ঘণ্টায় যেমন থাকবে আবহাওয়া Jul 07, 2025
img
আইসিসিতে নতুন প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব গ্রহণ Jul 07, 2025
img
শুল্ক ইস্যুতে আজ থেকে বিভিন্ন দেশে চিঠি পাঠাবেন ট্রাম্প Jul 07, 2025
img
শেখ হাসিনাকে ‘বাংলার ইয়াজিদ’ অ্যাখ্যা দিলেন সামান্তা শারমিন Jul 07, 2025
img
মেসিকে রাখতে বিশেষ ছক, ডি পলকে চায় মায়ামি Jul 07, 2025
img
এজবাস্টনে ভারতের ‘প্রথম’ টেস্ট জয়সহ সব কীর্তি Jul 07, 2025
img
শি জিনপিং নেই, ভার্চুয়ালে পুতিন! ব্রিকস সম্মেলনে বড় ধাক্কা! Jul 07, 2025
img
সন্ধ্যার মধ্যে দেশের ৬ অঞ্চলে ঝড়ের আভাস Jul 07, 2025
img
সরকার আশকারা দিচ্ছে বলেই মব হচ্ছে : মাসুদ কামাল Jul 07, 2025
img
মালয়েশিয়ায় ভিন্ন সাজে পরীমণি, তুললেন ঝড়! Jul 07, 2025
img
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ রাইট ট্র্যাকে উঠবে : মির্জা ফখরু‌ল Jul 07, 2025
img
আবারও ত্রুটিতে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট, জয়পুরে জরুরি অবতরণ Jul 07, 2025