মেডিকেলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বিশ্বরেকর্ড বাংলাদেশি ছাত্রের!

মেডিকেলে MRCP পরীক্ষায় এবার পাস মার্ক ছিল ৪৫৪, সেখানে অবিশ্বাস্য ও অতিমানবীয়ভাবে ৯০৬ নম্বর পেয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছেন তিনি। ওই পরীক্ষায় ৯০০ নম্বর ক্রস করা অতিমানবীয়। এটা এমন একটা পরীক্ষা যেখানে কঠিন clinical scenario এর পাশাপাশি ecg echo usg cxr ct mri সহ মোটামুটি সবকিছুই থাকে, থাকে না শুধু উত্তর দেয়ার সময় টা। অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর করতে হয়। গর্বের বিষয় হল মেডিকেল পরীক্ষায় বিশ্বরেকর্ড করা ড. মাহমুদুল হক একজন বাংলাদেশি। বিশ্বসেরা হওয়ার গল্পটা তার মুখ থেকেই শোনা যাক,

ড. মাহমুদুল হক : মেডিকেল লাইফের প্রথম থেকেই আমি সব কিছু বুঝে পড়ার চেষ্টা করতাম। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম যে সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। আর মানুষকে সুস্থ করার দায়িত্ব হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র দায়িত্ব, সব থেকে মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব কিন্তু সব থেকে কঠিন দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে কোন ত্রুটি রাখা চলবে না, নিজের শতভাগ ঢেলে দিতে হবে। আমি মনে করতাম যে হাসপাতাল এ আমি যে অসুস্থ বৃদ্ধ চাচাকে দেখব উনি নিশ্চয়ই কারো না কারো পিতা হবেন আর যে অসুস্থ বৃদ্ধা কে দেখব উনি নিশ্চয়ই কারো না কারো মা হবেন । নিজের বাবা- মা অসুস্থ হলে আমরা যেমন সব থেকে ভাল সেবা আশা করি তেমনি সেই অসুস্থ মা-বাবার সন্তানও নিশ্চয়ই তার মা-বাবার অসুস্থতার সময় ডাক্তারদের কাছ থেকে সব থেকে ভাল এবং সবথেকে সঠিক সেবাটাই আশা করেন। তাই আমি বিশ্বাস করতাম যেদিন কোন অসুস্থ মানব শরীরে হাত দিব সেদিন আমার বয়সের সাপেক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু জ্ঞান অর্জন করেই হাত রাখব।

কিন্তু প্রথম বর্ষ থেকে গাইটন এর Physiology বই ছাড়া অন্য কোন বই খুব একটা ভাল লাগে নাই। তাই আমি নিউ মার্কেট এর বই এর দোকানে গিয়ে সারাদিন মেডিকেল এর বই খুজতে থাকতাম। যদি কোন সহজ এবং বোধগম্য ভাবে লেখা ভাল বই পাওয়া যায়? একদিন সকালে আমি আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর লাইব্রেরি তে বই খুজতেছিলাম। তো হঠাৎ করেই আমার হাতে এসে পরল হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল এর Cardiology এর একটা বই। বই টির নাম ছিল Pathophysiology of Heart Disease. বইটির লেখক ছিলেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল এর cardiology এর প্রধান Leonard S. Lilly. বইটিতে এত সুন্দর করে হৃৎপিণ্ডের রোগ গুলোর ব্যাক্ষা ছিল যেটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

পরে জানতে পারি যে, ওই বইটি আমাদের লাইব্রেরিতে দান করেছিলেন শিশু সার্জারি বিভাগের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবদুল হানিফ টাবলু স্যার। আর বইটি স্যারকে দিয়েছিলেন নাহরিন হুসনা আহমেদ যিনি আমেরিকা তে থাকেন এবং কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশে এসে ঢাকা মেডিকেল এ প্রশিক্ষণ রত চিকিৎসকদের ultrasonography এর উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। এই বইটি পড়ার পর থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে হৃৎপিণ্ড ছাড়া ও অন্যান্য বিষয়ের উপর নিশ্চয়ই এরকম আরও সুন্দর সুন্দর বই আছে। তাই আমি নিউ মার্কেট এ Parash publishers এ তখন প্রতিটা বিষয়ের উপর যত বই পাওয়া যেত সব ই কিনেছি। তখন আমার সেকেন্ড প্রফ আসন্ন কিন্তু জানার নেশা আমাকে এমন ভাবে পেয়ে বসে যে আমি দুই মাস কলেজেই আসিনি, শুধু এই বইগুলো পড়েছি। ফলে প্রফের প্রস্তুতি নিতে পারিনি,সেকেন্ড প্রফটাও সময়মত দেয়া হইনি। হার্ভার্ড এর লেখকেরা কি কি বই লিখেছেন এগুলো ইন্টারনেট থেকে সার্চ দিয়ে বের করতাম এবং Amazon থেকে Parash publishers এর মালিকের মাধ্যমে ওই বই গুলো কিনে আনতাম।

এভাবে একটা বিষয় বুঝার পিছনে কখনো কখনো আমার লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতে আমি কিছুই মনে করতাম না। কারন knowledge অর্জনটাই আমার কাছে মুখ্য বিষয় ছিল। কোন কিছুর সম্পর্কে পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারা আমার কাছে নেশার মত হয়ে গিয়েছিল। একদিন আমার আব্বু একটা কাজে ৫০০০০/ পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ আমি তাকে ফোন দিয়ে বললাম যে, আমার কিছু বই কিনতে হবে যার জন্য ৫০০০০ টাকা লাগবে। ঠিক ওই মুহূর্তে আমার আব্বু তার প্রয়োজনীয় কাজটি না করে পুরো ৫০০০০ টাকা ই আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন । এই মেডিকেল জীবনে সহকর্মীদের কাছ থেকে হয়ত মানসিক সাপোর্ট কম পেয়েছি, কখনো হয়ত বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছি, কিন্তু একটা দিনের জন্য ও জ্ঞান অর্জন বন্ধ করি নাই। কারন আমার সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার বাবা-মা। মেডিকেল লাইফে যখনই খারাপ লাগত তখনই মা-বাবার কথা মনে করতাম। শুধু ভাবতাম ২ জন মানুষ কতটুকু dedicated হলে লক্ষ লক্ষ টাকা আমার বই কিনার পিছনে খরচ করতে পারেন। কাজেই শুধুমাত্র মা-বাবার জন্য হলেও আমাকে ভাল ডাক্তার হতে হবে। তাই এখনও আমি প্রতিদিন রিডিং রুম এ যাই পড়াশোনা করার জন্য। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, জ্ঞান অর্জন করাই হচ্ছে সব চেয়ে বড় শক্তি। মেডিকেল সায়েন্স হচ্ছে এমন একটা সায়েন্স যেখানে যার কাছে জ্ঞান আছে তার পিছনেই সবাই ছুটে। কারণ মানুষ সব কিছু নিয়ে ছাড় দিলেও নিজের অসুস্থতার ব্যাপারে ছাড় দিতে রাজি নয়।

আমি মনে করি ডিএমসির ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা ও মেধা পৃথিবীর যে কোন দেশের ছেলেমেয়েদের চাইতে বেশি। কিন্তু আমরা পিছিয়ে পড়ছি শুধু সিস্টেমের ত্রুটির কারণে। এজন্য বাইরের দেশের মেডিকেল শিক্ষা শেষে তারা অনেক আপগ্রেডেড হয়ে বের হয়ে আসে, অন্যদিকে আমাদের মেধা থাকা সত্ত্বেও সিস্টেমের কারণে আমাদের দিন দিন অবনতি হচ্ছে। আমেরিকায় যেখানে এমডি ডিগ্রি দিয়েই হয়ে যায়, সেখানে আমাদের ডিগ্রি নেয়া যেন আর শেষ হয়না। পৃথিবীর সেরা পেশেন্ট স্টাফ আমাদের আছে, কিন্তু যথাযথ জ্ঞানের প্রয়োগ আর নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকার কারণে এই বিশাল সুযোগের সদ্বব্যবহার আমরা করতে পারিনা।

আমি যখন কোন রোগীর শরীরে হাত রাখি, তখন তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মনে করেই হাত রাখি, সর্বোচ্চ পরিমানে শ্রদ্ধা অন্তরে ধারণ করেই তার শরীরে হাত রাখি এবং মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি সেই মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি যিনি আমাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীবের সেবা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। জীবনের এই পর্যায়ে এসে এতোটুকু বুঝতে পারি যে, মেডিকেল সায়েন্স এর জ্ঞান হচ্ছে একটা বিশাল বাগানের মত। সেই বিশাল বাগানে আমি হচ্ছি শুধুমাত্র ছোট্ট একটা ভ্রমর। কিন্তু আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি যে, এই ছোট ছোট ভ্রমর গুলোই একটু একটু ফুলের রস আহরণ করে একদিন বড় মধুর চাক তৈরি করবে। এই মেডিকেল সায়েন্স এর বিশালতার মাঝে ক্ষুদ্র আমি প্রায়শই বড় স্বপ্ন দেখি, দেখতে চাই।

লেখক : ড. মাহমুদুল হক জেসি
DMC K-6

 

টাইমস/জেকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সিঙ্গাপুর থেকে আসবে এক কার্গো এলএনজি, ব্যয় কত? Sep 16, 2025
img
কার বিরুদ্ধে মাঠে নামছে জামায়াত: জাহেদ উর রহমান Sep 16, 2025
img
টিকটক নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতা! Sep 16, 2025
img
পুলিশের ৯ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর Sep 16, 2025
img
আমাদের সার্বিক মূল্যস্ফীতি মোটামুটি স্থিতিশীল : অর্থ উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
আমার ধারণা জামায়াত একাত্তরের ভুল স্বীকার করে বিবৃতি দেবে : মাসুদ কামাল Sep 16, 2025
img
কাতারের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের Sep 16, 2025
img
বিচারপতির উপস্থিতিতে ৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৯ জনের ভার্চুয়ালি হাজিরা Sep 16, 2025
img
এনবিআরে বড় রদবদল, দপ্তর বদলালো ১৮২ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার Sep 16, 2025
img

নুরাল পাগলার মাজারে হামলা

আদালতে স্বীকারোক্তি দিল ৮ আসামি Sep 16, 2025
img
ক্রীড়া কর্মসূচি প্রকল্পে বরাদ্দের টাকা বেহাত, দুদকের অভিযান Sep 16, 2025
img
দুই কোটি রুপি ও স্বর্ণসহ সরকারি কর্মকর্তা গ্রেপ্তার Sep 16, 2025
img
২৬৬ কোটি টাকার ফাঁকিতে চাকরিচ্যুত ২ কর কর্মকর্তা Sep 16, 2025
img
কোনো ধর্মকে আলাদা করে দেখা যাবে না : প্রধান উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলার সেবা চালু করল হাইকমিশন Sep 16, 2025
img
দুর্যোগের আগে সবার কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছাতে কাজ করছে সরকার: উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
বাংলাদেশকে টপকে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শীর্ষে উঠতে চায় ভারত Sep 16, 2025
img

জোহরান মামদানি

‘পেনশন তহবিলের টাকা ইসরায়েলি বন্ডে বিনিয়োগ করা উচিত নয়’ Sep 16, 2025
img
ভাঙ্গায় সড়ক ও রেলপথে যান চলাচল স্বাভাবিক Sep 16, 2025
img
মবের মুল্লুক নামে আরো একটি কুখ্যাত বাগধারার কবলে পড়েছে দেশ: গোলাম মাওলা রনি Sep 16, 2025