শিশু দারিদ্র ঘুচাতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশ: নিউইয়র্ক টাইমস

উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে গত ১০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। ‘হোয়াট ক্যান বাইডেনস প্ল্যান ডু ফোর প্রোভার্টি? শিরোনামে নিবন্ধটি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথিতযশা কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ। নিকোলাস ক্রিস্টফ দুইবার পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার।

এই নিবন্ধে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, নারী শিক্ষার বিস্তার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যের বিস্তর প্রশংসা করা হয়েছে। জো বাইডেনের ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যানের সাথে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার তুলনা করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে যেহেতু পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে, তাই শিশু দারিদ্র বিমোচনে বাইডেনের পরিকল্পনাও সফল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ টাইমসের পাঠকদের জন্য ইংরেজি নিবন্ধটির অনুবাদ অংশ তুলে ধরা হলো। অনুবাদ করেছেন নাবিল জাহাঙ্গীর।

বিশ্বের অন্যতম ধনীদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বদনাম রয়েছে চাইল্ড প্রোভার্টি বা শিশুদের দরিদ্রতা বিষয়ে। সেই দুর্নাম ঘোচাতেই বড় ধরনের বাজেট ঘোষণা করেছে বাইডেন প্রশাসন। সব মিলিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ, যার বড় অংশই ব্যয় হবে শিশু দারিদ্র বিমোচনে।

গবেষকরা বলছেন বাইডেনের এই সাহসী পদক্ষেপ দেশটির শিশু দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইউনিভার্সিটি অব কলাম্বিয়ার মতে এতে করে এর হার প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পাবে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনা কি সফল হতে চলেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশেকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছেন নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃক প্রকাশিত ‘হোয়াট ক্যান বাইডেনস প্ল্যান ডু ফোর প্রোভার্টি? লুক টু বাংলাদেশ’ নিবন্ধে।

বাংলাদেশকে অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, মাত্র ৫০ বছর আগে গণহত্যা, অরাজকতা আর দ্রারিদ্রের মধ্যে জন্ম নেয়া দেশটিকে হ্যানরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ির সাথে তুলনা করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ছবি দেখে মানুষ ভেবেছিল ভবিষ্যতে দেশটির আর কোন আশা নেই।

১৯৯১ সালে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ে যখন প্রায় ১ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল তখন আমি নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলাম দেশটি ‘দুর্ভাগ্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ’। কিন্তু আমার সব নেতিবাচক ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে দেশটি গত তিন দশক ধরে দ্রুত গতিতে উন্নতির সোপান বেয়ে চলেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বেড়ে চলেছে। বর্তমান মহামারীর আগের ৪ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এমনকি চীনের থেকেও বেশি।

বাংলাদেশে গড় আয়ু বর্তমানে ৭২ বছর, যা যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ্যের থেকে বেশি। মিসিসিপির ১০টি কাউন্টির থেকে এটি বেশি। বাংলাদেশ এক সময় আশাহীনতার জন্মদিলেও, বর্তমানে দেশটি বিশ্বকে উন্নয়নের পথ দেখাচ্ছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের গোপন রহস্য কি? দেশটির শিক্ষা পরিকল্পনা এবং নারীদের অবদান এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

৮০ এর দশকে এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি সংখ্যক নারী প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারত। বিশেষ করে নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে খুব পিছিয়ে ছিল এবং অর্থনীতিতেও তাদের অবদান ছিল সামান্য।

কিন্তু সরকার এবং সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিক্ষা, বিশেষত নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষ জোর দেয়। বর্তমানে দেশটির প্রায় ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করছে। বর্তমানে দেশটির উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায়ে ছেলে শিশুর তুলনায় মেয়ে শিশুর সংখ্যা বেশি, বিস্তর লিঙ্গ বৈষম্য থাকা একটি দেশে এমন অর্জন প্রশংসা যোগ্য।

এছাড়াও বাংলাদেশের নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীন ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তার মতে, বাংলাদেশ তাদের নারীদের শিক্ষিত করে তুলেছে এবং এই শিক্ষিত নারীরাই দেশটির উন্নয়নের মূল খুঁটি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে গার্মেন্টস শিল্পের, এই গার্মেন্টস শিল্পের মূল চালিকা শক্তিও নারী শ্রমিক।

পশ্চিমাদের মানদণ্ডে বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি সমূহে মুজুরি কম, যৌন হয়রানির দুর্নাম রয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেশি এবং নিরাপত্তা কাঠামো কম। কিন্তু সব কিছুর পরেও বাংলাদেশের নারীরা ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করে নেয়ার থেকে গ্রার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বাঁধা হলেও, বর্তমানে অধিকাংশ নারীর গড়ে মাত্র দু’টি সন্তান রয়েছে।

ব্রাক ও গ্রামীন ব্যাংকের প্রশংসা করে তিনি লিখেন, এরা শিশুদের টিকাদান, স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেট ব্যবহার ও বাল্য বিবাহ রোধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

গত ১৫ বছরে প্রায় ২.৫ কোটি বাংলাদেশী নাগরিক দারিদ্রের অভিশাপমুক্ত হয়েছেন এবং বিশ্ব ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ এখন “দারিদ্র বিমোচনের অনুপ্রেরণার গল্প”। ১৯৯১ সালের পর থেকে শিশুদের পুষ্টিহীনতাও প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমানে তা ভারতের থেকেও কম।

ক্রিস্টফের মতে, বাংলাদেশ তার দরিদ্র ও পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর উন্নয়ণে বিনিয়োগ করেছে, কারণ এখান থেকেই সব থেকে বেশি লাভ উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ণে বাংলাদেশের সফলতা ইর্ষনীয়। যা আমেরিকার ক্ষেত্রেও সত্যি হতে পারে। আর একারণেই বাইডেনের পরিকল্পনা সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

 

 

 

 

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আইনের বাধায় সেনা প্রত্যাহার কার্যক্রম স্থগিত ট্রাম্পের Nov 16, 2025
img
জামিনের পর হিরো আলম, ‌‘আমাকে কেউ জিরো বানাতে পারবে না’ Nov 16, 2025
img
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ: অ্যাডহক কমিটি না থাকলে সভাপতির ভূমিকা ইউএনও-ডিসির Nov 16, 2025
img

পুলিশের কাছে নিখোঁজ তরুণীর বার্তা

আমাকে খুঁইজেন না, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আছি এবং ভালো আছি Nov 16, 2025
img
বক্স অফিসে অজয়-রাকুলের ছবি কেমন জমলো? Nov 16, 2025
img
নির্বাচনে যারা পেশিশক্তি দেখাবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে : ইসি সানাউল্লাহ Nov 16, 2025
img
বিআইআইএসএস-এর নতুন ডিজি রিদওয়ানুর রহমান Nov 16, 2025
img
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে চাচ্ছে: রিজভী Nov 16, 2025
img
এআই প্রযুক্তিতে বানানো ভুয়া ভিডিও নিয়ে সতর্ক করল অর্থ মন্ত্রণালয় Nov 16, 2025
img
কাফনের কাপড়ে রাস্তায় শুয়ে রিজভীকে আটকে দিলেন নেতাকর্মীরা Nov 16, 2025
img
২১ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে যান চলাচল সীমিত থাকবে Nov 16, 2025
img
জুলাই সনদ ও গণভোট ঝুঁকিতে পড়তে পারে : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি Nov 16, 2025
img
হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় আগামীকাল, ন্যায়বিচার চাইলেন মির্জা ফখরুল Nov 16, 2025
img
ফার্স্ট লুকেই ঝড় তুলেছে মহেশ-প্রিয়াঙ্কার সিনেমা Nov 16, 2025
সুখী পরিবার দুটি গুণ | ইসলামিক টিপস Nov 16, 2025
img
মিচেলের সেঞ্চুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাল নিউজিল্যান্ড Nov 16, 2025
img
ইবির পরীক্ষার হল থেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকর্মীকে থানায় সোপর্দ Nov 16, 2025
বাজরাঙ্গি ভাইজানের মুন্নি এবার দক্ষিণ ভারতের বড় পর্দায় Nov 16, 2025
সঞ্জয় কাপুরের মৃত্যু পরবর্তী সম্পত্তি বিবাদে হাইকোর্টের কড়া নজর Nov 16, 2025
যেখানেই গিয়েছি, সব জায়গায় নিজেকে উন্নতি করার চেষ্টা করি : সাইফ হাসান Nov 16, 2025