উন্মুক্ত কারাগারের গল্প

কারাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়তো আমাদের অনেকরই নেই। তবে কারাগার সম্পর্কে আমাদের কম-বেশ সবারই ধারণা আছে। আর সেটা হলো চারদিকে উঁচু দেয়াল আর লৌহ কপাট দ্বারা আবদ্ধ এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠ।

কিন্তু কেউ কি কখনো এমন কোনো কারাগারের কল্পনা করতে পারেন, যা চার দেয়ালে আবদ্ধ কোনো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ নয় বরং উন্মুক্ত এই কারাগারে আপনার জন্য থাকবে আলাদা ঘর। সেখানে আপনি জীবনসঙ্গীকে নিয়ে সংসার করতে পারবেন। নিজের পছন্দমত কাজ করতে পারবেন। প্রয়োজনে কিছু সময়ের জন্য শহরে যেতে পারবেন।

হ্যাঁ। বাস্তবে এমনই কিছু উন্মুক্ত কারাগার রয়েছে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য রাজস্থানের জয়পুরে অবস্থিত এমনই একটি কারাগার সাঙ্গানার উন্মুক্ত কারাগার। সেই কারাগারেই রয়েছে এক কয়েদি দম্পতি রামচন্দ ও সুজনা।

রামচন্দ ও সুজনা দু'জনেই হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তাদের আছে একটি ছোট্ট ঘর। সেই ঘরে টিভি, ফ্রিজ, খাট-পালংসহ দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো- তাদের এই ছোট্ট সংসারটি জয়পুরের সাঙ্গানার উন্মুক্ত কারাগারে অবস্থিত। আর তাদের বিয়েও হয়েছে এই কারাগারে। রামচন্দ স্কুলবাসের চালক। আর সুজনা একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। কয়েদি হলেও এই উন্মুক্ত কারাগারে বেশ সুখেই আছেন এই দম্পতি।

কেবল রামচন্দই নয়। তার মত প্রায় ৪৫০ জন কয়েদি আছেন জয়পুরের এই উন্মুক্ত কারাগারে। ১৯৫০ এর দশকে এই কারাগারের যাত্রা। রাজস্থানে এ ধরণের আরও ত্রিশটি উন্মুক্ত কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারে কোনো উঁচু সীমানা প্রাচীর নেই। কেন্দ্রীয় ফটকে নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরী। বরং কয়েদিদের বাইরে যেতে উৎসাহিত করা হয়। তারা নিজ উদ্যোগে কাজের ব্যবস্থা করেন এবং প্রতিদিন কাজ করতে যান।

তবে চাইলেও কয়েদিদের যে কেউ এখানে থাকতে পারেন না। যারা তাদের সাজার দুই-তৃতীয়াংশ ভোগ করে ফেলেন কেবল তারাই এসব কারাগারে থাকার সুযোগ পায়। সাধারণ কারাগার থেকে এখানে অনেক বেশি স্বাধীনতা রয়েছে। এখান থেকেই তারা জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন।

তাদের চাকরি থাকে, সংসার হয় এবং ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুলের ব্যবস্থাও রয়েছে। তাইতো যারা এখানে থাকার সুযোগ পায় তাদের অনেকেই এখান থেকে যেতে চায় না। তাই অনেক সময় কয়েদিদের মেয়াদ শেষ হলে তাদেরকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করতে বাধ্য হয় সরকার।

সাজাপ্রাপ্ত নারীদের অনেকেই বাইরের জীবন থেকে এই উন্মুক্ত কারাগার জীবনকে অনেক ভালো মনে করেন। কারণ বাইরের অনেকই তাদেরকে বিয়ে করতে চায় না। যেখানে কারাগারের ভেতরে তাদের জন্য জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ। যদিও কারাগারের পরিচয় পত্র দেখিয়ে কাজের ব্যবস্থা করা কিছুটা কঠিন। তারপরও তারা এখানে অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতে পারেন।

এখানে কয়েদিরা নিজ পছন্দমত মোটরসাইকেল, স্মার্টফোন, টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি কিনতে পারেন। সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয় যে, তাদেরকে কয়েদির কোনো পোষক পরতে হয় না। তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ছোট্ট ঘর বরাদ্দ থাকে। তবে তাদেরকে নিজ উদ্যোগে খাদ্য ও আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে হয়।

তাই প্রতিদিনই তারা কাজের সন্ধানে বের হন। তাদের কেউ কেউ নিরাপত্তা প্রহরী, কারখানার শ্রমিক, দিন মজুর কিংবা গাড়ি চালক। এমনকি তাদের মধ্যে এমনও রয়েছেন, যারা শরীর চর্চার শিক্ষক কিংবা নিকটবর্তী কোনো স্কুলের সুপারভাইজার।

তবে এই উন্মুক্ত কারাগারের একটাই নিয়ম, আর সেটা হল ‘রোল কল’। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই কারাগারের গভর্নিং বডির প্রতিনিধিরা প্রধান ফটকে দাঁড়ান এবং প্রত্যেকের রোল নম্বর অনুযায়ী নাম ডাকেন। এ সময় তাদের কেউ কেউকে বাড়ির আশে পাশে ময়লা ফেলা বা এ ধরণের নিয়ম বহির্ভূত কোনো কাজের জন্য তিরস্কার করা হয়। এ জন্য তাদেরকে জবাবদিহি করতে হয়, কিংবা কখনো সাধারণ বন্দী কারাগারেও ফেরত পাঠানো হয়।

আর কেবল ওই মুহূর্তটাতেই তাদের মনে হয়, যেন তারা কারাগারে আছেন। অন্যথায় তারা অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতই এখানে একটি সুখী-সুন্দর জীবনযাপন করে থাকেন।

উল্লেখ্য, ভারতের রাজস্থান এবং মহারাষ্ট্র রাজ্যে ৪২টি উন্মুক্ত কারাগার রয়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারতের মোট কয়েদির সংখ্যা ৪লাখ ১৯হাজার ৬২৩জন, যাদের মধ্যে ৩হাজার ৭৮৯জন কয়েদি থাকেন এসব উন্মুক্ত কারাগারে। মূলত অপরাধীদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যেই এই সুন্দর উদ্যোগ গ্রহণ করে রাজ্য সরকার।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হাজার কোটি টাকার মালিকরা এখন দৌড়ে বেড়াচ্ছেন : অর্থ উপদেষ্টা Sep 21, 2025
img
নেত্রকোনায় অর্ধশত কর্মীসহ বিএনপি নেতার জামায়াতে যোগদান Sep 21, 2025
img
ঢাকায় আজ হালকা বৃষ্টির আভাস Sep 21, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন আজ Sep 21, 2025
img
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সালাউদ্দিন আর নেই Sep 21, 2025
img
দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাচ্ছেন অভিনেতা মোহনলাল Sep 21, 2025
img
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের ২২ বস্তা ডকুমেন্টস উদ্ধার Sep 21, 2025
img
যে সিনেমার লাভের অংশ সবাইকে দিতে চান দুলকার সালমান Sep 21, 2025
img
বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে লাহোর, ঢাকার অবস্থান ৪র্থ Sep 21, 2025
img
ময়মনসিংহে শিয়ালের কামড়ে আহত ৬ Sep 21, 2025
img
সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু নয়, আমরা সবাই এ দেশের নাগরিক : কামরুল হুদা Sep 21, 2025
img
৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ কবে? Sep 21, 2025
img
ইলিশের স্বাদ নিতে হিমশিম ভারতীয় ক্রেতারা, দাম নাগালের বাইরে Sep 21, 2025
img
দেশের স্বার্থে জাতীয়তাবাদী পরিবারকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে : সেলিমুজ্জামান Sep 21, 2025
img
ইতিহাসে ২১ সেপ্টেম্বর কেন এত আলোচিত? Sep 21, 2025
img
বাংলাদেশি টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার Sep 21, 2025
img
শুভ মহালয়া আজ Sep 21, 2025
img
ম্যাচসেরা হওয়ার পর মুখ খুললেন সাইফ হাসান Sep 21, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Sep 21, 2025
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর চেতনার ব্যবসা আর চলবে না : সালাহউদ্দিন আহমেদ Sep 21, 2025