বাংলাদেশের উন্নয়ন মানেই ভারতের উন্নয়ন আর ভারতের উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশের উন্নয়ন : একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বহুজাতিক বেনিয়া জায়ান্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ব্রিটিশ কলোনিয়াল পাওয়ার তাদের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন শেষ করে যখন সর্বোচ্চ প্রফিট নিয়ে উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে (যদিও কতটা ধর্মীয় সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে) পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি হওয়া যতোটা না যৌক্তিক ছিলো তার চেয়েও ১৯৭১ সালের আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আরও বেশি যৌক্তিক ছিলো (যদিও সকল বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি দেশ হলেই বরং ভালো হতো এ কথাটিও অনেকেই বলে থাকেন)। কারণ ব্রিটিশদের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরও শোষণের শিকার হয়েছিলাম আমরা। তাছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কার প্রফিট বেশি আর কার প্রফিট কম হয়েছে, তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আমাদের স্বাধীনতা। তাই স্বাধীনতার কাছে এযাবৎকালের সব যুক্তিই পরাজিত তা বলাই যায়।

এবার আসি মূল আলোচনায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী তার কিছু অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ। একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে চেষ্টা করেছি কতোটা সহজভাবে সবার বোধগম্য করা যায়, জানিনা কতটুকু সফল হয়েছি।

৮ই অগাস্ট ২০২০ সাল অর্থাৎ গতবছর মেহেরপুরে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্ক। আর চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। কোনোভাবেই এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। তাছাড়া সম্প্রতি চীন বাংলাদেশকে ৮ হাজারের বেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। এটি আমাদের দেশের জন্য বড় পাওয়া। তবে এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি আরও বলেন ভারতের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক, আমাদের বিজয় মানেই ভারতেরও বিজয় এবং আমাদের উন্নয়ন মানেই ভারতেরও উন্নয়ন।

গত ২২ ডিসেম্বর ২০২০ সালে ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রী বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সীতাকুণ্ডে জীবন উৎসর্গকারী অর্ধশতাধিক ভারতীয় সেনার স্মরণে সীতাকুণ্ডে নির্মিত ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করার পর সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ-ভারত রক্তের সম্পর্ক, এটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকবে।

এই দুজন হাই প্রোফাইল ব্যক্তির বক্তব্য যদিও কাছাকাছি, তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাগুলো শুধু রাজনৈতিক মানদণ্ডে বিচার না করে এর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণও প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে।

আর তাই বক্তব্যটি যদি অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখি, তাহলে বলতে হবে তিনি অর্থনীতি ভালোই জানেন এবং বোঝেন। নির্দ্বিধায় তাঁর অর্থনৈতিক জ্ঞানের প্রশংসা করতে হবে কেননা তিনি একজন রাজনীতিবিদ হলেও অর্থনীতিরই ছাত্র ছিলেন। আর অর্থনীতিতো খুবই রাজনৈতিক একটি বিষয়।

অর্থনীতিতে ফরেন রিপেরকাশন ইফেক্ট (foreign repercussion effect) বলে একটা ধারণা রয়েছে, যেটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। একটি দেশের আমদানি বা রফতানি যখন অন্য আরেকটি দেশের জাতীয় আয়ে প্রভাব বিস্তার করে এবং পরবর্তীতে যখন আবার প্রথম দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ও জাতীয় আয়ে তার প্রভাব পরে, তাকেই ফরেন রিপেরকাশন ইফেক্ট বলে। তবে বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে একটি ছোট বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যায় বা অর্থনীতিতে ছোট করে দেখার সব রকম প্রচেষ্টা অনেক আগেই ব্যর্থ হয়েছে।

এখন আসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়, তিনি বলেছেন 'আমাদের উন্নয়ন মানেই ভারতেরও উন্নয়ন'। কথাটি যদি ফরেন রিপেরকাশন ইফেক্টের আলোকে ব্যাখ্যা করি, তাহলে দেখবো বাংলাদেশের জাতীয় আয় বেড়েই চলছে, আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২,২২৭ ডলার (যদিও আয় বৈষম্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে)। অপরদিকে ভারতের মাথাপিছু আয় ২,১৯১ ডলার। স্বাভাবিক ভাবেই ভারত যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বন্ধু, তাই আমাদের আমদানি বেড়ে যাবে (ভারত থেকে) আর তার প্রভাব পড়বে তাদের জাতীয় আয়ে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৯০ -১৯৯১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানি করে ২৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের অপর দিকে রফতানি করে মাত্র ২১ লাখ ডলারের পণ্য। আর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮০ কোটি ডলার, আর রফতানি ১১০ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি দুর্বার গতিতে অপ্রতিরোধ্য।

এখন ফরেন রিপেরকাশন ইফেক্টের আলোকে যদি বিষয়টি দেখি তাহলে বলতে হবে, এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতকে শুধু লাভবান বললে ভুল হবে বরং লাভের অংশীদার হিসেবেই মানায়।

এবার আসি মুদ্রা বিনিময়ের হার (নমিনাল এক্সচেঞ্জ রেট) অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকা এবং ভারতীয় রূপির বিনিময় হারের প্রভাব দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কী ভূমিকা রেখেছে?

মুদ্রা বিনিময় হারের সাথে আমদানি, রফতানির একটি শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। কোনও দেশের মুদ্রার মান কমে গেলে বা অবমূল্যায়িত হলে, স্বভাবতই সেই দেশের রফতানি বেড়ে যায়, আমদানি কমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মুদ্রা বিনিময়ের হার (নমিনাল এক্সচেঞ্জ রেট গড়) ছিল ১.৪৯ অর্থাৎ ১ রূপির বিনিময়ে ১.৪৯ টাকা বিনিময় হতো। তা ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ১.১৭। তাহলে ভারতীয় রূপির বিপরীতে বাংলাদেশের টাকার মানও অনেক বেড়েছে। কিন্তু মুদ্রার মান বাড়লেই দেশের উন্নয়ন হয়েছে বা উন্নয়নে এর প্রভাব পড়েছে, তা বলার সুযোগ নেই।

তবে এটির মাধ্যমে বাংলাদেশের আমদানি বেড়েছে, তা বলা অমূলক নয়। এবং ভারতের আয়ও বেড়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে আরও দ্রুত গতিতে। তার মানে বাংলাদেশের উন্নয়নের পলিসির ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভারতের অর্থনীতিতে।

এখন সময় এসেছে কিভাবে বাংলাদেশ, ভারতের সাথে তার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারে? আমরা যদি আমাদের রফতানি বাড়াতে না পারি বা রফতানি বাড়িয়েও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে না পারি, সেক্ষেত্রে হয় আমদানি কমাতে হবে আর না হয় ভারতের বিকল্প বাজার খোঁজা যেতে পারে।

যদিও বাংলাদেশের সাথে ভারতের যেই আবেগ বা ভালোবাসার সম্পর্ক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছিল, সেই ভালোবাসা আমরা কতটুকু ধরে রেখেছি আর ভারত কতটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করেছে তা সবার কাছে একরকম নয়। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, 'আমাদের উন্নয়ন মানেই ভারতেরও উন্নয়ন'।

মোঃ আনোয়ার হোসেন

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি), মিরপুর, ঢাকা।

 

টাইমস/এনজে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিসিবির কাছে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কোয়াবের দাবি Sep 16, 2025
img
ভেনেজুয়েলার নৌযানে মার্কিন হামলা, নিহত ৩ Sep 16, 2025
img
ইয়্যুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড পেলেন রাকসুর শিবির প্যানেলের দ্বীপ Sep 16, 2025
img
কাতারে আর হামলা করবে না নেতানিয়াহুর দেশ : ট্রাম্প Sep 16, 2025
img
লুট করা জিনিস কেনা বা বিক্রির বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি নেপালে Sep 16, 2025
img
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান মালয়েশিয়ার Sep 16, 2025
img
ঢাকায় বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস Sep 16, 2025
img
ফিরছে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ফুটবল-ক্রিকেটে জমজমাট রাত Sep 16, 2025
img
ইইউ বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ Sep 16, 2025
img
হামাস যেখানেই থাকুক, হামলা করা হবে : নেতানিয়াহু Sep 16, 2025
img
দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে কিনশাসা, ঢাকার অবস্থান ২৩তম Sep 16, 2025
img
শরীর নয়, মন ভালো রাখতেও জরুরি সঠিক খাবার Sep 16, 2025
img
১৬ সেপ্টেম্বর: ইতিহাসে এই দিনে আলোচিত কী ঘটেছিল? Sep 16, 2025
img
শেরপুরে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে এসে রোহিঙ্গা যুবক আটক Sep 16, 2025
img
সাতক্ষীরায় ১ দিনে পানিতে ডুবে কিশোরসহ প্রাণ হারাল ৪ Sep 16, 2025
img
চ্যাম্পিয়নস লিগ শুরুর আগে সুসংবাদ পেল রিয়াল মাদ্রিদ Sep 16, 2025
img
৩ জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার Sep 16, 2025
img
৩ চাকার যানবাহনগুলো সঠিক গবেষণার মাধ্যমে সমাধানের তাগিদ Sep 16, 2025
img
খুলনায় আড়াই মণ হরিণের মাংসসহ আটক ১ Sep 16, 2025
img
ভালুকায় শ্রমিকলীগের ২ নেতা গ্রেপ্তার Sep 16, 2025