বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ধর্মীয় ভাবগণ্ডিকে পেরিয়ে রোমান্সের ধারা সূচনাকারী হিসেবে মুসলমান কবিদের মধ্যে আলাওল অন্যতম। তার মেধা ও প্রতিভার মাধ্যমে স্থান করে নিয়েছিলেন আরাকান রাজসভায়। আলাওল বাল্যকালেই বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল।
কবি আলাওল আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে (মতান্তরে ফরিদপুর জেলার ফতেয়াবাদ পরগনার জালালপুর গ্রামে) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের অধিপতি মজলিস কুতুবের একজন অমাত্য। বাল্যকাল থেকেই যুদ্ধবিদ্যা ও সঙ্গীত বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল।
আলাওলের জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে আরাকানে। আরাকানের রাজার অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেলে একসময় তিনি হয়ে পড়েন রাজসভার কবি। তাকে কাব্যচর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন রাজার একজন প্রধান কর্মচারী কোরেশী মাগন ঠাকুর। এছাড়াও সৈয়দ মুসা, সুলায়মান, মুহাম্মদ খান কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তিনি তাদের কাছ থেকে সাহিত্যচর্চা ও গ্রন্থ রচনায় প্রেরণা লাভ করেছিলেন।
এক সময় বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আলাওল পঞ্চাশ দিন কারাভোগ করেন। পরে আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা স্ত্রীপুত্রসহ প্রায় দশ বছর অতিবাহিত করেন।
আলাওল ছিলেন বহু গুণে বলীয়ান। সে সময়ে তার সমপর্যায়ের কবি উপমহাদেশে ছিলোনা বললেই চলে। তিনি মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা। আলাওলের প্রধান কাব্য পদ্মাবতী (১৬৪৮), যা ছিল কবি মালিক মোহাম্মদ জায়সীর হিন্দি কাব্য পদুমাবৎ-এর অনুবাদ। আরাকানপতির আত্মীয় সৈয়দ মুসা'র উৎসাহে তিনি সয়ফলমুলুক বদিউজ্জামাল (১৬৬৯) নামক পারস্য গ্রন্থ অনুবাদ করেন। মধ্যযুগের আরেক কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী (১৬৫৯) শেষ করেন আলাওল।
এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে- সপ্তপয়কর (১৬৬৫), সিকান্দরনামা (১৬৭৩), তোহফা (১৬৬৪) এবং সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য রাগতালনামা। এ ছাড়া কিছু গীতিকবিতা আছে। রাগতালনামা ও গীতিকবিতাগুলো তার মৌলিক রচনা; অন্যগুলো অনুবাদ।
‘পদ্মাবতী’ তার সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। নাগরিক শিক্ষা, বৈদগ্ধ ও অভিপ্রায় তার কাব্যের ভাব-ভাষা-রুচিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। কাব্যিক আবেগের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার সংমিশ্রণ থাকায় আলাওলকে ‘পণ্ডিতকবি’ বলা হয়।
মহাকবি আলাওলের স্মরণে ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক ১৯৭৪ সাল থেকে দুই বছর পরপর আলাওল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে আসছে।
তার নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে ‘আলাওল হল’।
প্রতিভাবান এই কবি আনুমানিক১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
টাইমস/এসআর/এইচইউ