সিলেটের গৌরবময় ইতিহাস

মহান সাধক হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরান (র.) সহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের ভ্রমণবিবরণী থেকে এ জেলা সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। দশম শতাব্দীতে মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ পশ্চিমভাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি এ জেলা জয় করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা সিলেট বা শ্রীহট্ট বহু আগে থেকেই এটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক হযরত শাহজালাল (র.) সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাছাড়া মুঘলদের সাথে যুদ্ধ, নানকার বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার অবদান অপরিসীম।

নামকরণের ইতিহাস

বিখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক আল-বিরুনী তার ‘কিতাবুল হিন্দ’ নামক গ্রন্থে সিলেটকে ‘সিলাহট’ নামে উল্লেখ করেন।

সিলেট নামের উৎপত্তি নিয়ে প্রাচীন গ্রন্থাদিতে বিভিন্ন নামের উল্লেখ আছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শিবের স্ত্রী সতি দেবীর কাটা হস্ত (হাত) এই অঞ্চলে পড়েছিল, যার ফলে 'শ্রী হস্ত' হতে শ্রীহট্ট নামের উৎপত্তি বলে হিন্দু সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক এরিয়ান লিখিত বিবরণীতে এই অঞ্চলের নাম ‘সিরিওট’ বলে উল্লেখ আছে। এছাড়া খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে এলিয়েনের বিবরণে ‘সিরটে’ এবং পেরিপ্লাস অব দ্যা এরিথ্রিয়ান সী নামক গ্রন্থে এ অঞ্চলের নাম ‘সিরটে’ এবং ‘সিসটে’ এই দুইভাবে লিখিত হয়েছে।

অতঃপর ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চল ভ্রমণ করে তার ভ্রমণ কাহিনীতে এ অঞ্চলের নাম ‘শিলিচত’ উল্লেখ করেছেন।

তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে এদেশে মুসলিম সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটলে মুসলিম শাসকগণ তাদের দলিলপত্রে ‘শ্রীহট্ট’ নামের পরিবর্তে ‘সিলাহেট’, ‘সিলহেট’ ইত্যাদি নাম লিখেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ মিলে। আর এভাবেই শ্রীহট্ট থেকে রূপান্তর হতে হতে একসময় সিলেট নামটি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন।

প্রচলিত আছে হযরত শাহ্জালাল (রা.) যখন ‘সিলেটে’ আসেন তখন শত্রু পক্ষ তাকে এবং তার অনুসারী ৩৬০ আউলিয়াদেরকে ‘শিলা’ বা ‘পাথর’ দ্বারা আটকে দিয়েছিল। তখন মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানীতে তিনি বলেন ‘শিলাহাট’ (অর্থাৎ- পাথর সরে যা)। তখন পাথর গুলো সরে যায়। এই থেকে নাম রাখা হয় ‘শিলাহাট’। তারপর নাম সহজ করতে করতে হয় ‘শিলহাট’, ‘সিলাহেট’, ‘সিলেট।

অন্য আরেক প্রচলিত ধারণা, এক সময় সিলেট জেলায় এক ধনী ব্যক্তির একটি কন্যা ছিল। তার নাম ছিল শিলা। ব্যক্তিটি তার কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি হাট নির্মাণ করেন এবং এর নামকরণ করেন শিলার হাট। এই শিলার হাট নামটি নানাভাবে বিকৃত হয়ে সিলেট নামের উৎপত্তি হয়।

ইতিহাস

সিলেটের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে এই অঞ্চলের প্রাচীন সীমানার যে উল্লেখ পাওয়া যায় সে অনুসারে তৎকালীন শ্রীহট্টমণ্ডল বর্তমান সিলেট বিভাগের চেয়ে আয়তনে অনেক বড় ছিল, এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান সরাইল বা সতরখণ্ডল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত), জোয়ানশাহী (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত), ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অনেকাংশ শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ কামাখ্যা তন্ত্র অনুযায়ী প্রাচীন কামরুপ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমাই প্রাচীন শ্রীহট্ট ছিল অর্থাৎ শ্রীহট্ট ছিল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত।

অতপর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক রূপরেখার বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে সিলেট বিভাগের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ ত্রিপুরা রাজ্যের অধিকারভুক্ত এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের অনেক অংশ হরিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অবশিষ্টাংশে শ্রীহট্টের প্রাচীন রাজ্য জয়ন্তীয়া, লাউড় ও গৌড় বিস্তৃত ছিল। দশম শতাব্দীতে মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ পশ্চিমবাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি সিলেট জয় করেছিলেন।

ঐতিহাসিকদের ধারণা, সিলেট বা শ্রীহট্ট (সমঋদ্ধ হাট) বহু আগে থেকেই একটি বর্ধিষ্ণু বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বর্তমান ছিল। প্রাচীন শ্রীহট্টে বিপুল হারে বাঙালি অভিবাসন হয়েছিল। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (রা.) সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সুলতানী আমলে সিলেটের নাম ছিল জালালাবাদ। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের সময়ে সিলেটে বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয়। নানকার বিদ্রোহ সিলেটের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নানকাররা ছিল জমিদারদের ভূমিদাস। নানাকার বিদ্রোহ সহ আরও কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হলে ১০৫০ সালে এ প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। 

প্রতিষ্ঠাকাল

সিলেট জেলা ১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত এ জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিলেট পৌরসভার সৃষ্টি করা হয় ১৮৭৮ সালে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক মারাত্মক ভূমিকম্প গোটা শহরটিকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তীতে ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে উঠে ইউরোপীয় ধাঁচের আরও সুন্দর ও আধুনিক শহর। ১৮৯০ এর দশকের শেষ ভাগে বেশ কিছু রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়।

১৯১২-১৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি শাখা সিলেটের সাথে সংযুক্ত হলে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সিলেটের বিচ্ছিন্নতার প্রকৃত অবসান ঘটে। চা শিল্পের কারণে বিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে প্রবাসী সিলেটিদের এবং সিলেট শহর দ্রুত নগরায়ন ঘটতে থাকে এবং বর্তমানে ও তা অব্যাহত রয়েছে।

১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত (১৯০৫-১৯১১ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ সময়ের কালটুকু বাদ দিয়ে) সিলেট আসামের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তখন প্রশাসনিক ভাবে সিলেট ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন এর সময় বৃহত্তর সিলেট জেলাকে ০৪ (চার) টি নতুন জেলায় বিভক্ত করা হয়। এই নতুন জেলাগুলো হলো : সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট দেশের ষষ্ঠ বিভাগ হিসেবে মর্যাদা পায় এবং মূলত বৃহত্তর সিলেট জেলার সীমানাই নতুন সিলেট বিভাগের আওতাভুক্ত করা হয়।

বর্তমানে সিলেট জেলায় ১২ টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। ১২ টি উপজেলা হচ্ছে- বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা ও জকিগঞ্জ।

বর্তমানে সিলেট জেলার আয়তন ৩,৪৯০.৪০ বর্গ কি.মি.। উত্তরে ভারতের খাসিয়া-জৈইন্তা পাহাড়, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, পূর্বে ভারতের কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা উপস্থিত।

সিলেটে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। যার মধ্যে গড়দুয়ার ঢিবি, গায়েবী মসজিদ, হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহ্পরানের (র.) দরগাহ, আবু তোরাব মসজিদ, নবাবী মসজিদ, আখালিয়ার মুঘল মসজিদ, ঢাকাদক্ষিণ মন্দির, তিন মন্দির ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও সিলেটে রয়েছে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বহু দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা। প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থী সিলেটের দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে আসেন।

 

টাইমস/এমএএইচ/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
‘তোমরা হাতাহাতি করবা আর ভোট করে দিবো আমি, মামার বাড়ির আবদার’ Sep 05, 2025
img
ঢাকার ধানমণ্ডি থেকে আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার Sep 05, 2025
img
নুরের ঘটনা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কড়া বার্তা দিলেন ফুয়াদ Sep 05, 2025
img
৪৬টি সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনল নির্বাচন কমিশন Sep 05, 2025
img

ডাকসু নির্বাচন:

ডাকসু ক্যাফেটেরিয়াকে কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে ছাত্রদল Sep 05, 2025
img
‘১ ২ ৩ ৪, প্রক্টর তুই গদি ছাড়’, চবিতে স্লোগান Sep 04, 2025
img
দুবাইয়ে ১২০০ কোটি টাকা পাচার, স্ত্রীসহ সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা Sep 04, 2025
img
এবার কাদেরকে সমর্থন দিলেন ছাত্রদল সভাপতি Sep 04, 2025
img
নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র বিএনপি মেনে নেবে না: আবদুল কাদির Sep 04, 2025
লিফলেট নয়, সিল দিয়ে প্রচারণায় এজিএস প্রার্থী আবিদ! Sep 04, 2025
৩১ দফা বাংলাদেশের মুক্তির রক্ষাকবচ - বুলু Sep 04, 2025
জুলাই অভ্যুত্থান প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে জামায়াতের সমালোচনা করে যা বললেন তারেক Sep 04, 2025
মব জাস্টিস নয়, জনগণের রায় চাই-আমির খসরু Sep 04, 2025
img
বাংলা গানে অভিষেক রাহাত ফাতেহ আলী খানের! Sep 04, 2025
জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দল নিষিদ্ধ না হলে সরকারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি Sep 04, 2025
img
লাইসেন্স ছাড়া বাজার পরিচালনা করলে ব্যবস্থা নেবে ডিএসসিসি Sep 04, 2025
শান্তিচুক্তি না হলে সামরিকভাবেই লক্ষ্য পূরণের হুঁশিয়ারি পুতিনের| Sep 04, 2025
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনায় যা বলছে পুলিশ Sep 04, 2025
অবিশ্বাস্য বাজেট! ১২০টি দেশে মুক্তি পাবে প্রিয়াঙ্কা-মহেশের সিনেমা Sep 04, 2025
রিল ভিডিওতে বন্ধুত্বের বার্তা, মিমি-শুভশ্রীর এই জুটি মুগ্ধ করল নেটপাড়া Sep 04, 2025