জিআইভিত্তিক পর্যটন কেন নয়?

পর্যটনশিল্পের টেকসই উন্নয়নে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সমন্বয় জরুরি। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে মেলবন্ধন ঘটলে পর্যটনশিল্প হবে দীর্ঘস্থায়ী। ‘প্রকৃতির রাণী বাংলাদেশ’ বলা হলেও দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদার খুবই সামান্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পর্যটনশিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।

কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের শাড়ির ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতির জন্য সামাজিক আন্দোলন ঘটে গেলো বাংলাদেশে। বাংলাদেশের আগে ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় টাঙ্গাইলের শাড়িকে নিজেদের জিআই পন্য দাবি করে তোলপাড় ফেলে দেয়। এরপরই দাবি উঠে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত পণ্য জিআই তালিকাভূক্ত করার। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত পন্য জিআই তালিকাভূক্ত করলেই কি দায় মুক্ত হবে? পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামনে সুযোগ আছে জিআইভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার।

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তথ্য মতে, সারাদেশে প্রায় ১৫শ এর মতো পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। তবে বহুল পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে ৫০টির কাছাকাছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত জিআই পণ্য রয়েছে ২৮টি। এছাড়াও দেশব্যাপী জিআই তালিকাভূক্ত পণ্য নিবন্ধনের কাজ জোরভাবে চলছে।

জিআই পন্য তালিকাভূক্তির এই তোড়জোড়ের মধ্যেই টাঙ্গাইলের শাড়ির খোঁজ নিতে গেলে বাধে বিপত্তি। শাড়ি বুননের দৃশ্য দেখা মিলেনা কোথাও। স্থানীয়রাও অবগত না, কোথায় গেলে দেখা মিলবে শাড়ি বুননের? শাড়ি পল্লীর খোঁজ করেও জবাব মেলেনি স্থানীয়দের।

২০১৬ সালে জামদানি শাড়িকে বাংলাদেশে প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এরপর স্বীকৃতি পায় আরও ২০টি পণ্য। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুর কাটারীভোগ, বাংলাদেশ কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, বাংলাদেশের শীতল পাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলশীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা। সম্প্রতি অনুমোদিত ৩টি পণ্য- টাঙ্গাইল শাড়ী, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা ও গোপালগঞ্জের রসগোল্লা। এছাড়াও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে- জামালপুরের নকশি কাঁথা এবং যশোরের খেঁজুর গুড়।

নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লার নাম সারাবিশ্বে সমাদৃত। কিন্তু সেই কাঁচাগোল্লার খোঁজ নিতে গেলে মেলা ভার। রাজশাহীর সিল্ক, ঢাকাই মসলিন আর শীতলপাটি তো হারাতেই বসেছে। জিআই তালিকাভূক্ত বেশিরভাগ পন্যের তৈরী প্রক্রিয়া বা আদিস্থান দেখতে চাইলেও সম্ভব না। রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম; বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ মিললেও একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি কোনো দর্শণীয় স্থান অথবা পর্যটন কেন্দ্র। জিআই পন্য তালিকাভূক্ত করার পাশাপাশি প্রয়োজন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা। যাতে করে দেশ ও বিদেশের যে কোনো পর্যটক চাইলেই এসব পন্য তৈরীর প্রক্রিয়া, উৎপত্তিস্থল ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জিআইভিত্তিক পর্যটন গড়ে তুললে স্থানীয় মানুষ এসব পেশায় আরও বেশি আকৃষ্ট হবে। পন্য বিক্রির আয়ের পাশাপাশি পর্যটন থেকেও বাড়তি আয় আসবে সংশ্লিষ্ট মানুষের। জিআই পন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইট’ হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটন খাত বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও বাণিজ্য উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। পৃথীবির অনেক দেশ পর্যটন খাতের উপর ভর করে তাদের অর্থনীতি সাজিয়েছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হয়ে উঠেছে- পর্যটন খাত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. সন্তোষ কুমার দেব বলেন, জিওগ্রাফিকাল আইডেন্টিফিকেশন যে সব পন্য আছে যেমন নাটোরের কাঁচাগোল্লা, কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের চমচম; এরকম অনেক পন্য আছে যেসবের টেস্ট নেয়ার জন্য পর্যটকরা এক জয়েগা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমন করে। আবার প্রাচীন ঐতিহাসিক কাল থেকে জামদানি, ঢাকাই মসলিন কাপড়ের কথা আমাদের পূর্বসূরীদের কাছ থেকে শুনে আসছি। বিদেশী পর্যটকরাও ‘জিওগ্রাফিকাল আইডেন্টিফিকেশন’ এসব পন্য কেনার জন্য বা দেখার জন্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে আসে। আমরা এই জিআইভিত্তিক পর্যটন গড়ে তুলতে পারলে এসব পণ্যের ব্র্যান্ড ভ্যালু আরও বাড়বে।

পণ্য কেন্দ্রিক পল্লী গড়ে তোলার পরামর্শ দিযে তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের শাড়ি, ঢাকাই মসলিন অথবা টাঙ্গাইলের চমচম; এ কেন্দ্রিক পল্লী গড়ে তোলা যায়। তাহলে পর্যটকরা এসব পন্য তৈরীর প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও জানতে পারবে। এতে করে স্থানীয় মানুষের আয়ের উৎস বাড়বে। মানুষ এসব পেশায় আরও উদ্বুদ্ধ হবে। স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
এবার কী তাহলে ইরানকে সঙ্গ দেবে রাশিয়া? Oct 08, 2025
img
বিদেশি ফুটবলারদের নাগরিকত্ব জাল, মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ফিফার অভিযোগ Oct 08, 2025
img
ড্রাগ টেস্ট মিস করায় ইউএফসি ফাইটার ম্যাকগ্রেগরকে ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা Oct 08, 2025
img
বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারাল হেফাজত নেতা, চট্টগ্রামে মহাসড়ক অবরোধ Oct 08, 2025
img
এনসিপির ২ নেতার টিভি মালিকানা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য নুরের Oct 08, 2025
img
বিএনপির বৃহত্তর চীন শাখার বনভোজন অনুষ্ঠিত Oct 08, 2025
img
প্রভাবিত হয়ে ‘শাপলা’ দিতে গড়িমসি করছে ইসি : সারজিস Oct 08, 2025
img
মেসির সতীর্থের অবসর ঘোষণা Oct 08, 2025
img
সেপ্টেম্বরে সংক্ষিপ্ত বিচারে ২৫৭ মামলার নিষ্পত্তি Oct 08, 2025
img
আবর্জনা আপলোড করা কারও কাজ হতে পারে না : পিয়া জান্নাতুল Oct 08, 2025
img
নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবিতে মালদ্বীপে প্রবাসীদের স্মারকলিপি Oct 08, 2025
img
হিমাচলে ভূমিধসের কবলে যাত্রীবাহী বাস, প্রাণ হারাল ১৮ Oct 08, 2025
img
টি-টোয়েন্টির পর এবার ওয়ানডে হোয়াইটওয়াশের লক্ষ্য মিরাজদের Oct 08, 2025
img
বিতর্কিত সিদ্ধান্তে দু’বার জীবন পান নাইট, হতাশ বাংলাদেশ Oct 08, 2025
img
মাদ্রাসা ক্রিকেট চালুর কথা জানালেন বুলবুল Oct 08, 2025
img
নবনির্বাচিত বিসিবি সভাপতিকে নাকভির শুভেচ্ছা Oct 08, 2025
img
মাগুরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল ২ Oct 08, 2025
img
বাংলাদেশি টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার Oct 08, 2025
img
আজ ঢাকার ৪ এলাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ Oct 08, 2025
img
দুপুরের মধ্যেই দেশের ৭ অঞ্চলে ঝড়ের আভাস Oct 08, 2025