বিশ্বকাপ জয়ের পর আজেন্টাইন কিংবদন্তি লিওনেল মেসির দলবদলের খবর তখন সর্বত্র আলোচনায়; সৌদির কোনো ক্লাব নাকি আমেরিকার ইন্টার মিয়ামি, কোথায় ভেড়াবে তরী? বিশ্বজুড়ে সমর্থকদের এমন গুঞ্জনকে কাজে লাগান সৌদির পর্যটন মন্ত্রণালয়। ফেসবুকে সৌদি আরবের গাছপালা ও সবুজ প্রকৃতির ছবি আপলোড করেন মেসি। যার ক্যাপশনে লিখেন, ‘কে ভেবেছিল সৌদিতে এরকম সবুজ আছে? আমি এমন অপ্রত্যাশিত বিস্ময় যখনই সম্ভব হয় তখনই খুঁজতে বের হই।’ ক্যাপশনের শেষে ব্যবহার করেন—‘ভিজিটসৌদি’ হ্যাশট্যাগ। ভ্রমণপিপাসুদের সৌদি ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান তিনি। এরপর জানা যায় মেসি সৌদির কোনো ক্লাবে নয়, দেশটির ভ্রমণ বিষয়ের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ হয়েছেন। এ কারণেই তিনি এমন পোস্ট করেছেন। সৌদি আরবের পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে এমন উদ্যোগ নেন কর্তৃপক্ষ।
উন্নয়নশীল দেশের সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হতে পারে পর্যটন শিল্প। পর্যটকদের আকর্ষণে দরকার তাই পরিকল্পিত ব্র্যান্ডিং। যার অন্যতম উদাহরণ—সৌদির পর্যটন মন্ত্রণালয়। বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতির ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে পর্যটন শিল্পের উপর। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পর্যটন খাতও বেশ সমৃদ্ধ। প্রতি বছর আইপিএল-কে কেন্দ্র করে পর্যটনের ব্যাপক ব্র্যান্ডিং করে দেশটি। দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়দের দিয়ে পর্যটন বিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকেন। বাংলাদেশে নামিদামি তারকা থাকলেও নেই পর্যটনের ‘অ্যাম্বাসেডর’।
অস্ট্রেলিয়া তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য পর্যটন প্রসারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং-এর অন্যতম মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে ‘আই লাভ অস্ট্রেলিয়া’ পেজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ করছে। ইউরোপের দেশ চেক রিপাবলিক, যার রাজধানী প্রাহা (প্রাগ), ইনস্টাগ্রামে ‘প্রাহা ওয়ার্ল্ড’ পেজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করে দেশটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য পর্যটনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে।
করোনার সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি; পর্যটন শিল্প। পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম যে পাঁচটি সেক্টর চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে পর্যটন খাত উল্লেখযোগ্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি পর্যটনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে বৈশ্বিক এই সংস্থাটি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে বিদেশি পর্যটকদের আসার হার প্রতিনিয়ত কমছে। ২০১৯ সালে ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন বিদেশি পর্যটক দেশে আসেন। এরপর কভিডের প্রভাবে ২০২০ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জনে। ২০২১ এবং ২০২২ সালে তা দেড় লাখে নেমে এসেছে।
বিদেশী পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম জায়গা হলো ব্র্যান্ডিং। আমরা কতটা আকর্ষণীয় করে ব্র্যান্ডিং করতে পারি তার উপর নির্ভর করবে আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধি। কিন্তু, দেশ হিসেবে আমাদের সব ধরনের উপকরণ থাকার পরও কাজে লাগাতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। উচ্চ ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদানসহ দেশের অর্থনীতিতে শতভাগ মূল্য সংযোজন হলেও বাংলাদেশের প্রধান ১০টি খাতের তালিকায় নেই পর্যটন খাত। ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ খাতের বিকাশে সরকারি নীতিসহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং।
‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং থিম ও ওয়েবসাইট দিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ এবং দেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে এ ব্র্যান্ড থিমটি দেয়া হলেও তেমন সাফল্য আসেনি। নতুন ব্র্যান্ডিং থিম ও আইকনিক ল্যান্ডমার্ক নির্ধারণে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
পর্যটক আকর্ষণ এবং দেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে নানা উপাধিতেই পরিচিত অনেক দেশ। বাংলাদেশও ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হতে চেয়েছিল। তবে ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ পর্যটক আকর্ষণের জন্য উপযুক্ত ও সুনির্দিষ্ট নয়। পর্যটনসংশ্লিষ্টদের মতে, সব দেশই নিজেদের সুন্দর বলে দাবি করে। ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়, যা অন্য কোনো দেশের নেই। এ উপলব্ধি থেকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং থিম পরিবর্তনেরও উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড।
থিম নির্ধারণের পাশাপাশি নির্ধারণ করা হবে দেশের শীর্ষ স্থাপত্য আইকন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন- ‘তাজমহল’ ভারতের, ‘আইফেল টাওয়ার’ ফ্রান্সের, ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ বহন করে। তেমনি বাংলাদেশেরও একটি আইকন নির্বাচন করে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. সন্তোষ কুমার দেব বলেন, আমাদের রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। তার সঙ্গে রয়েছে—সুন্দরবন, যেখানে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কুয়াকাটায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটও রয়েছে। সেই সঙ্গে কান্তজীর মন্দির থেকে শুরু করে সিলেটের জাফলং। রাতারগুল, বিছনাকান্দি, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ নদী কেন্দ্রিক পর্যটন রয়েছে। পদ্মা সেতুর পলে উত্তরাঞ্চলে পর্যটক সংখ্যা বাড়ছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গাকে কেন্দ্র করে যে কর্ণফুলী টানেল হয়েছে, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে প্রায় ৮০ কিলোমিটারের যে মেরিন ড্রাইভটি রয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার রেল চালু হয়েছে। ঝিনুক আকৃতির রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে।
এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলংকার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, শ্রীলংকা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে প্রোমো বানিয়েছে রেল নিয়ে। তাতে দেখা যায়, ভারত মহাসাগরের তীরঘেঁষে যে রেললাইন চলে গেছে, রেলে বসে ভারত মহাসাগরের নান্দনিক দৃশ্য দেখবে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বলা যায়, বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। এসব পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র করে প্রমো তৈরি করা হলে তা ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম হতে পারে। তাতে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যে এম্বাসিগুলো রয়েছে, একজন পর্যটক যখন ভিসার জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে, সে ওয়েবসাইটে একটু পর পর পর্যটন আকর্ষণগুলোর ছবি, ভিডিও কনটেন্টগুলো যদি থাকে, তাহলে একজন পর্যটক ঢাকায় ঘুরতে এলেও কক্সবাজারের ছবি দেখে তার ইচ্ছা হবে যে ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজার ঘুরে দেশে ফেরত যাবে।
পর্যটক আকর্ষণে ব্র্যান্ডিংটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আমরা কাঙ্ক্ষিত ব্র্যান্ডিংটা করতে পারিনি। এজন্য ছোট ছোট প্রমো ভিডিওগুলো দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মার্কেটিং করা গেলে, পেজ খুলে সেগুলো বুস্টিং করে আন্তর্জাতিক বাজারে যদি প্রমোট করা যায়, ইনস্টাগ্রামে যদি বিউটিফুল বাংলাদেশ কনসেপ্ট বা অন্য কোনো ব্র্যান্ডিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এগোনো যায় তাহলে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে।