দেশের নদ নদীতে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বেশি মিলছে

দেশের নদী থেকে প্রতিদিন ৫৪৭ টন মাছ ধরা হয়। অথচ শুধু পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা থেকে প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক আসে- এমন ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
২০০২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। এর দুই বছরের মধ্যে বাজারগুলো প্রায় পলিথিনমুক্ত করে ফেলা হয়। উদ্যোগ, ব্যবস্থা সেখানেই শেষ। এর পর আবারও রাজত্ব শুরু এ ব্যাগের। অবশেষে অন্তবর্ী সরকার পলিথিন ব্যবহারে কড়াকড়ি করছে। সুপারশপে নিষিদ্ধ এখন পলিথিন। কিন্তু তাতে পলিথিন কি বন্ধ হয়েছে?
দেখা গেছে< পলিথিন এখন বৈধ পণ্যের মতোই ব্যবহার হচ্ছে হরদম। দেশে প্রতিদিন ৩ হাজার কারখানায় ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হলেও ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপক হারে। আর নানা প্লাস্টিক পণ্য বিষিয়ে তুলছে পরিবেশ।
ব্যবহারের পর যত্রতত্র ছুড়ে ফেলা প্লাস্টিক সময়ের সঙ্গে ক্ষয় হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয় (দৈর্ঘ্যে ৫ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট) এবং পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে মানুষ ও বাস্তুতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক পরিবেশে দিনের পর দিন থেকেও এর কোনো ক্ষয় হয় না এবং এটি আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়েছে। মায়ের বুকের দুধে প্রথমবারের মতো মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করেছেন ইতালির বিজ্ঞানীরা। এতে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এর মধ্য দিয়ে নবজাতকের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তবে তারা মনে করেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকজনিত ঝুঁকির তুলনায় শিশুর জন্য মায়ের দুধের উপকারিতা বেশি। দেশের নদী থেকে প্রতিদিন ৫৪৭ টন মাছ ধরা হয়। অথচ শুধু পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা থেকে প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক আসে।
এ বছরের শুরুতে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বাংলাদেশ সাসটেইনেবিলিটি অ্যালায়েন্স (বিএসএ) আয়েজিত ‘প্লাস্টিক এবং পরিবেশ’ বিষয়ে সংলাপে মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি এখন অন্তর্তীয় সরকারের একজন উপদেষ্টা। মূলত তারই উদ্যোগে পলিথিনের বিরুদ্ধে একটা কঠোর অবস্থানে যেতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্লাস্টিক কোনো সস্তা পণ্য নয়। আপাতদৃষ্টিতে সস্তা মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাবটি বিপুল। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহারের প্রসার ও দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণের বড় উৎস একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। পাতলা প্লাস্টিকের মোড়ক, কফির কাপ, ঢাকনা ও চামচ, স্ট্র ও পলিথিন ব্যাগ– এসব কিছুই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। দেশে এসব প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের ব্যাগের পরিবর্তে হাটবাজারে ও পণ্যের প্যাকেজিংয়ে পরিবেশবান্ধব দেশীয় উপাদান যেমন– পাট, কাপড় ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে দেশীয় পণ্যের প্রসার ঘটবে।
পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকার উল্টো পথে হাঁটছে বলে মন্তব্য করে বেলার প্রধান নির্বাহী বলেন, একসময় প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পলিথিন ব্যাগে এখন বাজারভর্তি। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। বাজার তদারকিও নেই। আমাদের আইনে বলা আছে, ১৪টি পণ্যে পলিথিন প্যাকেট দেওয়া যাবে না। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ থাকে একেবারেই অপ্রতুল।
প্লাস্টিক নিয়ে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে বলে মনে করেন রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, আমরা মনে করছি প্লাস্টিক সস্তা। কিন্তু লবণ, চিনি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আমার-আপনার পেটের ভেতরেও প্লাস্টিক প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মায়ের দুধেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কম দামের প্লাস্টিকে সাময়িক লাভ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।
প্রবন্ধে বেলার প্রধান নির্বাহী বলেন, ২০০৫ সালে দেশে বছরে জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ কেজি। একটা প্লাস্টিক বোতল ১ হাজার বছর, পলিব্যাগ ৪৫০ বছর ও প্লাস্টিকের স্ট্র ৭০০ বছর টিকে থাকতে পারে। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ টন প্লাস্টিক বিভিন্ন সমুদ্রে যাচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর এক লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে।
তবে দেশেই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের যথেষ্ট বিকল্প রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেশি দায়িত্ব উৎপাদকদেরই নিতে হবে। ভোক্তাদের আচরণে বদল আনাও তাদের দায়িত্ব। তাদের প্লাস্টিকের বিকল্প দিতে হবে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাদা আইন প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে প্লাস্টিক পণ্যের পুনর্ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে পুনর্ব্যবহার-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই। বর্তমানে প্লাস্টিক রিসাইকেলের পুরো বিষয়টি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মাধ্যমে চলছে।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, কিছু প্লাস্টিক রিসাইকেল হলেও তার মা-বাবা নেই। এই রিসাইকেলে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো কে তদারক করছে? কোনো কোনো গবেষণা বলছে, রিসাইকেল প্লাস্টিকের রাসায়নিক আরও বেশি ভয়ানক হতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর কি এই রিসাইকেলের সনদ দিচ্ছে? বিএসটিআই কি কোনো মানমাত্রা নির্ধারণ করেছে? ফলে যে প্লাস্টিক এখন রিসাইকেল হচ্ছে, সেগুলোর মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রিসাইকেল-বিষয়ক নীতিমালা হওয়া জরুরি।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্‌। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন, যা মানব ইতিহাসে আগে কখনও মুখোমুখি হতে হয়নি। এ বিষয়ে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।
প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’– এই প্রশ্ন তোলেন সংলাপে অংশ নেওয়া প্লাস্টিক উৎপাদক আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, প্লাস্টিকের সুবিধাভোগী তো সবাই। ভোক্তা কম দামে কিনতে পারছেন, বিক্রেতারা লাভ করছেন। হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। সরকারও এই খাত থেকে আয় করছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর কাজ কীভাবে শুরু হবে, প্লাস্টিকের বিকল্প কী হবে, পুনর্ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মার্কিন শুল্ক ইস্যুতে সরকারকে সমন্বিত সহযোগিতা করা হবে: আমীর খসরু Jul 15, 2025
img
ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে গণভোট লাগবে : আলী রীয়াজ Jul 15, 2025
img
৫ জেলায় পরিবহন ধর্মঘট রোববার Jul 15, 2025
img
শুটিং শেষে ভ্রমণ মুডে দেব, সপরিবারে ছাড়লেন লন্ডন Jul 15, 2025
img
দ্বিকক্ষের সংসদ নিয়ে ঐকমত্য হয়নি, কমিশনের সিদ্ধান্তের পর প্রতিক্রিয়া জানাবে বিএনপি : সালাহউদ্দিন আহমদ Jul 15, 2025
img
আমির খানের হাতে উঠছে ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক সুপারহিরো মিশন Jul 15, 2025
img
জুলাই অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে: সালাহউদ্দিন আহমদ Jul 15, 2025
img
সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত Jul 15, 2025
img
পাবনায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ১২ নেতাকর্মী কারাগারে Jul 15, 2025
img
দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিল আনুরাগ বসুর শহুরে গল্প Jul 15, 2025
img
সোশাল মিডিয়ায় অর্জুনকে নিয়ে শ্রীদেবীকন্যার বড় ইঙ্গিত Jul 15, 2025
img
পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী Jul 15, 2025
img
প্রেমিক শিখরের ছবি ও নাম লেখা টি-শার্টে প্রেমের প্রকাশ জাহ্নবীর! Jul 15, 2025
img
সিঙ্গাপুরকে বন্দর উন্নয়নে বিনিয়োগের আহ্বান নৌ উপদেষ্টার Jul 15, 2025
img
নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র চলছে: এজেডএম জাহিদ হোসেন Jul 15, 2025
img
প্রথম ঝলকেই হৃদয়ে জায়গা করে নিল ‘প্রেমান্তে’ Jul 15, 2025
img
চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক Jul 15, 2025
img
১৬ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক Jul 15, 2025
img
জেলা কোচদের জন্য বিশেষ কোর্স পরিচালনা বিসিবির Jul 15, 2025
img
১৬ জুলাই মার্চ টু গোপালগঞ্জ, আমরা আসছি: সারজিস Jul 15, 2025