আজকের পর্ব : " কিডনি ডায়ালাইসিস ও অর্থনৈতিক প্রভাব"

আল্লাহ তায়ালা কত বড় ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় মানব সৃস্টির মাধ্যমে অনেকটা অনুমান করা যায়। আল্লাহ তায়ালা " পরম করুণাময়, অসীম ও সীমাহীন দয়াবান।

"কিডনির পরিচয়"

মানব দেহের অভ্যন্তরভাগে উদর গহ্বরের পশ্চাৎভাগে মেরুদণ্ডের দুই পাশে দুটি কিডনি অবস্থিত। কিডনির দৈর্ঘ‍্য ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি। আকারে অনেকটা শিমের মতো। রং খানিকটা লালচে বাদামী। প্রতিটি কিডনি স্বচ্ছ ও পাতলা পেরিটোনিয়াম ঝিল্লি দ্বারা আবৃত থাকে এর ভেতর দিয়ে ইউরেটার ও রেনাল শিরা বের হয় এবং রেনাল ধমনী ও স্নায়ূ কিডনিতে প্রবেশ করে। লিভারের অবস্থানের কারণে ডান কিডনি বাম কিডনি অপেক্ষা সামান্য নিচে থাকে।

"কিডনির কাজ"

কিডনি হলো মেরুদণ্ডী প্রাণিদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি দেহের রেচন তন্ত্রের প্রধান অংশ। এর প্রধান কাজ রক্ত ছেঁকে বর্জ্য পদার্থ (যেমন ইউরিয়া) পৃথকীকরণ ও মূত্র উৎপাদন। মানব দেহের সমুদয় রক্ত দিনে প্রায় ৪০ বার কিডনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়াও দেহে পানি ও তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ বা ইলেকট্রোলাইট যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদির ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়া এটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসাবে হরমোন নিঃসরণ করে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

"ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন"

মানুষের শরীরে শারীরিক বিপাকের ফলে যে বর্জ্য তৈরী হয় তা শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য কিডনি ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে। কিডনি শরীরে প্রবাহিত সমস্ত রক্ত ছেকে পানির সাথে মিশিয়ে মূত্র হিসেবে শরীরের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। কোন কারণে কিডনি নষ্ট হলে কিডনির পরিবর্তে কৃত্রিম ছাঁকনি ব্যবহার করে তার মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবাহিত সমস্ত রক্ত ছেঁকে শরীর থেকে বর্জ্য বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয় ডায়ালাইসিস্ এবং যে কৃত্রিম ছাঁকনি দিয়ে এ ছাঁকন প্রক্রিয়া করা হয় তাকে বলা হয় ডায়ালাইজার।

একটি কৃত্রিম মেশিনের সাহায্যে রক্ত ফিল্টার করে বর্জ্য পরিশোধন করা হয়। কিডনি যখন সঠিকভাবে কাজ করে না তখন একজন মানুষকে আপাতত শুধুমাত্র বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিডনির পরিবর্তে মেশিনের সাহায্যে কাজটি করা হয়।

সপ্তাহে দু–তিন দিন নির্দিষ্ট একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস নেওয়ার জন্য আসতে হয়, প্রতিদিন চার ঘণ্টা হিসাবে রক্ত পরিশোধন করা হয়। পঞ্চম ধাপের ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগীদের বেলায় এটি জীবনভর চলতে থাকে। তবে সাময়িক কিডনি বিকলের বেলায় বিষয়টি ভিন্ন, সাধারণত কয়েকটি ডায়ালাইসিসের পর তাদের কিডনি রোগ ভালো হয়ে যায়।

"ডায়ালাইসিসের পূর্ব প্রস্ততি"

আগে থেকেই বাম হাতে একটি আর্টারিওভেনাস ফিসচুলা (এভি ফিসচুলা) করার দেড়-দুই মাসের মাথায় ওই তৈরি ফিসচুলা দিয়ে ডায়ালাইসিস করা যায়। অথচ রোগীরা যখন নেফ্রোলজিস্টের কাছে আসেন এবং সিরাম ক্রিয়েটিনিন লেভেল মোটামোটিভাবে চার-পাঁচের মধ্যে চলে আসে তখনই চিকিৎসক তাকে ফিসচুলা করিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের রোগীদের অনেকের মধ্যেই অযথা এমন একটি ডায়ালাইসিস ভীতি কাজ করে যে, তারা ডায়ালাইসিস না করে কত দিন থাকা যায় সে জন্য অপেক্ষা করে। এক পর্যায়ে যখন অবস্থা এমন মরণাপন্ন হয়ে যায় তখন চিকিসকের শরণাপন্ন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। হাতে ফিসচুলা করে ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করার মতো সময় আর থাকে না। বাস্তবিক কারণেই রোগীকে ইমার্জেন্সি ডায়ালাইসিসের নিমিত্তে ফিমোরাল বা জগুলার ক্যাথেটার করিয়ে নিতে হয় যা খুব স্বল্পস্থায়ী এবং রোগীর অতিরিক্ত খরচ হয়ে যায় যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

"ডায়ালাইসিসের খরচ"

ডায়ালাইসিস একটি মোটামুটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা প্রক্রিয়া। একবার ডায়ালাইসিস শুরু করলে সাধারণত জীবনভর তা চালিয়ে যেতে হয়। এর একটি সেশনও মিস করা যায় না। শ্বাসপ্রশ্বাসের মত এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া। নিয়মিত ভাবে ডায়ালাইসিসের খরচ যোগাতে গিয়ে অনেককে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। অনেকে আবার সংসার খরচের পাশাপাশি, তার ব্যয়সংকুলানের কথা চিন্তা করে ডায়ালাইসিসই করে না বা শুরু করার কিছুদিন পর তা বন্ধ করে দেয় এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। সরকারী অনুদান বা ভর্তুকি ও বিত্তবানদের সাহায্য সহযোগিতা পেলে, অনেকের পক্ষে নিয়মিতভাবে ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়া অনেকটা সহজ হয়, আরও কিছুদিন তারা সুস্থভাবে বেঁচে থেকে পৃথিবীর আনন্দ উপভোগ ও স্রষ্ঠার গুণগান করতে পারে।

ডায়ালাইসিসের জন্য সরকার নির্ধারিত কোনো ফি নেই। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে একক হাসপাতালে একক রকম। ডায়ালাইসিসের খরচের ভিন্নতা রয়েছে। সরকারী হাসপাতালে প্রত্যেক বার ৪০০ টাকা থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালে ৫০০০ টাকা থেকে ৭০০০ টাকা। আবার নামীদামী হাসপাতালে উচ্চবিত্তদের জন্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগে। আমাদের দেশে এই রোগটির চিকিৎসা ব্যয় বহুল, পরিবারের জন্য কষ্টসাধ্য। আমাদের দেশে এধরনের রোগের জন্য সরকার কর্তৃক কোন ভর্তুকি বা অনুদান বা সাহায্য সহযোগিতা করা হয় না।

পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যারা যোগ্য তাদের জন্য সরকার কর্তৃক ডায়ালাইসিসের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়। চীন তাদের দেশে সরকারীভাবে ব্যয়ভার বহন করছে।

ডায়ালাইসিস সাধারণত তীব্র (স্বল্পমেয়াদী) এবং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি ব্যর্থতার চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। যদিও রোগীরা দীর্ঘ সময়ের জন্য ডায়ালাইসিসে বেঁচে থাকতে পারে। তবে নির্বাচিত ক্ষেত্রে একটি কিডনি প্রতিস্থাপনই চূড়ান্ত চিকিৎসা।

ডায়ালাইসিস রোগী বয়স্ক, ডায়াবেটিস রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, নিম্ন রক্তচাপ হার্ট সমস্যা থাকলে দীর্ঘদিন ডায়ালাইসিস করা রোগী ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে হয়ে পড়ে। এক সময় সৃত্নিশক্তি হারিয়ে যায়,কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়, ব্রেনহেমারেজ হয়, হার্টঅ্যাটাক হয়। অনেক সময় লো ব্লাড পেসার কারনে ডায়ালাইসিস টেবিলে মৃত্যুবরণ করে। ডায়ালাইসিস চলাবস্থায় আইসিওর প্রয়োজন হয় এবং আবার কখনো কখনো লাইফ সার্পোট এর দরকার হয়। শেষ পরিনতি হয় মৃত্য।

এই রোগটি ধীরে ধীরে রোগীর মানুষিক শক্তি ভেঙে দেয়, রোগটি ব্যয় বহুল হওয়ায় অর্থাভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়, পরিবার অর্থ কষ্টে ভুগতে থাকেন।
ডায়ালাইসিসের মাধ্যে এই রোগটি ভালো হওয়া সম্ভব নয়। সাময়িক বা কিছু সময়ের বেচে থাকা সম্ভব। এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদি এবং ব্যয় বহুর চিকিৎসা। বয়স তুলনামুলক কম হলে কিডনি ট্র্যান্সফার করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু কিডনি ট্র্যান্সফার অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল।

পরামর্শ

নম্বর- ০১

কিডনি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্যে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতি ৭ জনে একজন কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন সবাই সচেতন হলে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

নম্বর-২

আমাদের দেশে সবার জন্য হেলথ ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামুলক করা দরকার। এ রোগের কারনে এক সময়ে রোগী মৃত্য বরন করে এবং পরিবারে নিদারুন অর্থ কষ্ট দেখা দেয়। এ ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন: ক্যান্সার, কিডনি ফেইল, ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করার জন্য বর্হিবিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশে সরকারী ভর্তুকি, অনুদান থাকা দরকার।

ধন্যবাদ
আজ এ পর্যন্ত অন্য কোন পর্বে আবার দেখা হবে।

লেখক: মোঃ আব্দুল কুদ্দুস, জেনারেল ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংক পিএলসি।

Share this news on: