অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে প্রাধান্য পেয়েছে সংস্কার

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণ-অভ্যূত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। পতন হয় সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের। সেদিন গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখলে নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। আজ ৩ মাস পূরণ হলো অন্তর্বর্তী সরকারের। দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে দেশের বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছে এই সরকার।

এ সরকার এমন একটা সময়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পায়, যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের সব সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়েছে।

এ সময়ের মধ্যে অনেক বিষয়ে সফলতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম দিকে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদল করেছে সরকার। রাষ্ট্রের কাঠামোগত এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। স্বৈরাচার সরকারের আমলে জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা স্থানীয় সরকারের কথিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে সেই জায়গায় অস্থায়ী প্রশাসক বসানো হয়েছে। স্থায়ী প্রশাসক নিয়োগের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে আলাদা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার।

আওয়ামী সরকারের অবসানের পর মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের ব্যাপারে বিপুল আশা ও উদ্দীপনা। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনে অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। সেই জায়গাগুলো সংস্কারের জোরদার করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করতে নেওয়া হচ্ছে উদ্যোগ। এরই মধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তা হলো- সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতে সাহায্য করছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, ঋণদাতা সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং ইউনূস সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

প্রথম দিকে নানান চাপে ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকারের কাছে একের পর এক দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হতে থাকেন বিভিন্ন মহলের লোকজন। কেউ আসেন চাকরি জাতীয়করণের জন্য, কেউ গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে। এ ছাড়াও ঘটেছিল মব জাস্টিজের ঘটনা, শিক্ষকদের পদত্যাগ, সচিবালয়ে আনসারের অবরোধ কর্মসূচি। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ নিয়েও বেশকয়েক দিন আন্দোলন চলছিল। শেষমেশ সেটা রুখতেও সফল হন সরকার। সবই সামাল দিতে হয়েছে এই সরকারকে।

এদিকে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে টানাপড়েন এরই মধ্য শুরু হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ সংলাপে নির্বাচনই প্রাধান্য পেয়েছে। তারা এই সরকারের কাছে নির্বাচন ও সংস্কারের একটি রোডম্যাপ চেয়েছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখনো কোনো রোডম্যাপ দেয়নি। বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দুটি কমন চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন তা হলো- দ্রব্যমূল্য এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা। এর বাইরে সংস্কার, নির্বাচন ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছেন তারা।

এ ছাড়া নতুন সরকার আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস বলে ৮টি জাতীয় দিবস বাদ দিয়েছে। দিবসগুলো হলো— ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস এবং ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এই দিবসগুলো বাতিলের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় দিবসগুলো জাতীয় দিবস হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো জাতীয় দিবস হওয়ার মতো নয়।

এদিকে জুলাই-আগস্ট গণহত্যা নিয়ে বিচারকাজ শুরু করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া পৃথক অভিযোগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক মন্ত্রী-ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র‍্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের আসামি করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাস পূর্ণ করার পর সফলতার পাশাপাশি কিছু ব্যর্থতাও লক্ষ্য করা যায়। তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রশাসনে গতি ফেরেনি। শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা পদে ব্যাপক রদবদল হলেও একাধিক মন্ত্রণালয়ে সচিব নেই। আড়াই মাস পেরিয়েছে ঢাকা, রংপুর বিভাগে কমিশনার এবং আট জেলা ডিসি ছাড়াই। পুলিশে ব্যাপক রদবদল হলেও কাজে গতি ফেরেনি। বলা যায়, পুলিশ এখনো এক ধরনের নিষ্ক্রিয়। ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ঢাকায় অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি নিয়ে চলছে মানুষ।

এ ছাড়া সরকার বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও সেটা দৃশ্যমান নয়। চাঁদাবাজি, দখলদারত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। সরকারের সে ব্যাপারেও কার্যকর ভূমিকা দৃশ্যমান নয়।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
চলে গেলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সরোজা Jul 14, 2025
img
সন্ধ্যার মধ্যে দেশের ৬ অঞ্চলে বজ্রসহ ঝড়ের আভাস Jul 14, 2025
img
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে কানাডাকে অনুরোধ করলেন পররাষ্ট্রসচিব Jul 14, 2025
img
সিলেটে এনসিপি কমিটির ৩ নেতার পদত্যাগ Jul 14, 2025
বোরকায় মুখ ঢেকে আদালতে অপু বিশ্বাস, পেলেন জামিন Jul 14, 2025
img
২০২৯ ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ হতে পারে ব্রাজিলে! Jul 14, 2025
img
আটক হলেন বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাসার Jul 14, 2025
img
ইসরায়েলি হামলায় সামান্য আহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান Jul 14, 2025
img
যুক্ত হওয়ার পরে বুঝতে পারি, ওই প্ল্যাটফর্ম খুবই অগোছালো: উমামা ফাতেমা Jul 14, 2025
img
সুইস বিনিয়োগকারীর আইনি পদক্ষেপের হুমকি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে Jul 14, 2025
img
বার্সেলোনার নজরে ১৭ বছরের ব্রাজিলিয়ান বিস্ময়বালক! Jul 14, 2025
img
নির্দোষ দাবি করে আদালতে ন্যায়বিচার চাইলেন নাসির ও তামিমা Jul 14, 2025
img
জুলাই ঘোষণাপত্র দরকার, সেটা সরকার করবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে : রবিউল আলম Jul 14, 2025
img
চেলসি তারকার গলা চেপে ধরার ব্যাখ্যা দিলেন কোচ এনরিকে Jul 14, 2025
img
সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০ জন নিহত Jul 14, 2025
img
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের চরিত্রহননের চেষ্টা হচ্ছে: মির্জা ফখরুল Jul 14, 2025
img
অপরাধ বাড়ার দাবি পুরোপুরি সত্য নয় : প্রধান ‍উপদেষ্টা Jul 14, 2025
img
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল ছবিগুলো তাসনিয়া ফারিণের নয় Jul 14, 2025
img
পোকা দমনে মাছি চাষের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের Jul 14, 2025
img
বরগুনায় জেলা নির্বাচন অফিসে অগ্নিকাণ্ড, নথিপত্র-ভোটার তালিকা পুড়ে ছাই Jul 14, 2025