রিজার্ভ, ব্যাংক ও মূল্যস্ফীতিতে ১০০ দিনে যা করলো অন্তর্বর্তী সরকার

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার অল্পদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। যেগুলোর কোনো কোনোটির ফলাফল ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আবার কোনো উদ্যোগকে তেমন কার্যকর নয় মন্তব্য করে সেগুলোর কিছু কারণও বিশ্লেষণ করছেন তারা।

অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট ইনভেস্টোপিডিয়া অনুযায়ী, কোনো দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তারা মুদ্রানীতির নির্ধারণের মধ্য দিয়ে সেটি করে থাকে।

দেশের অর্থনীতির আলোচিত তিনটি বিষয় হচ্ছে- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যাংক খাত এবং মূল্যস্ফীতি। গত ১০০ দিনে এসব খাতে যেসব পরিবর্তন এসেছে-

রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স:
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের অগাস্টে, ৪৮ বিলিয়ন ডলার। কোভিড মহামারি পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এর সঙ্গে নানান উপায়ে অর্থ পাচারকেও বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাসের কারণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। রিজার্ভ ক্রমশ নিম্নমূখী হতে থাকলে পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে, প্রায় প্রতি মাসেই রিজার্ভের পরিমাণ আগের মাসের তুলনায় কমেছে। দেশটির রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ছিল ১৩৩ কোটি ডলার। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রায় ২৪০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, জুলাই মাসের পর থেকে ফরমাল চ্যানেলে (প্রাতিষ্ঠানিক পথে) রেমিট্যান্স ফ্লো বেড়েছে। আগে যেখানে মাসে ১৫০ বা ১৭০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসতো, খুব ভালো হলে ২০০ কোটি ডলার হতো, এখন সেখানে প্রতি মাসে ২০০ কোটির ওপরেই থাকছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসে এই অংক ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। জুলাইয়ে ছিল ১৯১ কোটি ডলার, অগাস্টে ২২২ কোটি আর সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ স্থিতিশীল অবস্থায় আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, অফিশিয়াল চ্যানেলে মুদ্রা পাঠানোর ক্ষেত্রে যে রেট প্রদান করা হয়, সেটাকে বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাখতে পারলে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকবে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর স্থানীয় গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে জানান, ওই পাওনা পরিশোধ করতে ‘রিজার্ভে হাত দিতে হয়নি’।

অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে. মুজেরী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে অনেকটাই সঙ্গতিপূর্ণ করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঠেকানো গেছে বলে মনে করেন তারা।

ব্যাংক খাত:
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এমন অবস্থায় রয়েছে যেখানে ব্যাংকগুলো ‘সবল ব্যাংক’ এবং ‘দুর্বল ব্যাংক’ এই দুই ধারায় শ্রেণিভুক্ত। অনাদায়ী ঋণ ও খেলাপি ঋণের কারণে এ খাত ক্রমশ ‘বিপর্যস্ত’ হয়ে পড়ে। গত কয়েক মাসে ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয়া হয়েছে।

তারল্য সংকটের কারণে ১১ আগস্ট ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ৭ সেপ্টেম্বর থেকে সেই সীমা তুলে নেয়া হয়। এখনও তারল্য সংকটে ভুগছে কিছু ব্যাংক। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না তারা।

২৪ সেপ্টেম্বর বেসরকারি খাতের নয়টি ব্যাংকের চলতি হিসেব প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায় ব্যাংকগুলোতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৬৭ টাকা। সম্প্রতি সাতটি দুর্বল ব্যাংককে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অতিরিক্ত কোনো টাকা না ছাপিয়ে সবল ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এই টাকা দেয়া হয়েছে।

তবে সামগ্রিকভাবে এই উদ্যোগের সুফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে. মুজেরী। তিনি বলেন, এইভাবে শুধু ঋণ দিয়ে সাময়িকভাবে পারফর্ম করানো সম্ভব। কিন্তু এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দেবে না। কারণ, দুর্বলতার কারণ দূরীভূত হচ্ছে না।

মূল্যস্ফীতি:
বাংলাদেশের মানুষকে কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে। খরচ সামলাতে গিয়ে অসন্তোষ তীব্র হয়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের।

গণঅভ্যুত্থানে সরকার বদলালেও এই একটি জায়গায় কোনো বদল আসেনি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক আট সাত শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যেখানে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ছয় ছয় শতাংশ। সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল নয় দশমিক নয় দুই।

সংকোচন মুদ্রানীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার নীতি সুদ হার বাড়িয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে। পেঁয়াজ, ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যে শুল্ক প্রত্যাহার ও হ্রাস করেছে সরকার।

জাহিদ হোসেন বলেন, বাজারে গিয়ে ডান্ডাবাজি করা, এই ওষুধটা রোগের চেয়েও ভয়ংকর। একটা দাম বেধে দিলাম, বাজারে গিয়ে সেই দামে না পেলে জরিমানা করলাম, ধমকাধমকি করলাম... এই মডেল কখনো কাজ করে না। মার্কেট পুলিশিং নেভার ওয়ার্কস্।

তিনি বলেন, আগের সব সরকারই লোক দেখানোর জন্য ‘মার্কেট পুলিশিং’ করেছে। এই সরকারও সেটা করছে। বাজার তদারকির সময় খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতাদের জরিমানা করা হয়।

তিনি আরও বলেন, মার্কেট মনিটরিং বলতে যা করতে হবে তা হলো বড় বড় পাইকারি বাজারগুলোতে কে কোন দরে, কত পরিমাণ বিক্রি করছে, গুদামে কত আছে, আমদানি কত হলো, উৎপাদন কেমন হয়েছে এই তথ্যগুলো জনসমক্ষে নিয়মিতভাবে তুলে ধরা।

গত ১১ নভেম্বর একটি অর্থনৈতিক সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুদ্রানীতির সুফল পেতে অন্তত এক বছর লাগবে। মাত্র চার মাস পার করেছি, মূল্যস্ফীতি কমাতে আরো আট মাস সময় দিতে হবে।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভয়েস অব আমেরিকার জরিপ এক বছরের মধ্যে নির্বাচন চান ৬১.১ শতাংশ মানুষ Nov 23, 2024
img
পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে ৩ শিক্ষার্থী নিহত, আহত ১০ Nov 23, 2024
img
রোববার ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় Nov 23, 2024
img
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় হাসপাতালের পরিচালকসহ নিহত ৬ Nov 23, 2024
img
ট্রাম্পের অর্থমন্ত্রী পদে স্কট বেসেন্টের মনোনয়ন Nov 23, 2024
img
সম্পদের হিসাব জমা না দিলে সরকারি চাকরিজীবীদের যেসব শাস্তি হতে পারে Nov 23, 2024
img
যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের সঙ্গে বসতে চান পুতিন, দিবেন একাধিক শর্ত Nov 23, 2024
img
সাংবাদিকদের সঙ্গে সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় আজ Nov 23, 2024
img
বৃষ্টির বাগড়ায় আগেভাগেই প্রথম দিনের সমাপ্তি, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো উইন্ডিজও Nov 23, 2024
img
আমদানির সাড়ে তিনগুণ দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে আলু Nov 23, 2024