নিউইয়র্কে নির্বাচন

আমার ধারণা, এখন পৃথিবীর সবচেয়ে অমানবিক জায়গা হচ্ছে এয়ারপোর্ট। যারা এয়ারপোর্টে কাজ করে নিশ্চয়ই তাদের কানের কাছে ২৪ ঘণ্টা বলা হয়, ‘পৃথিবীতে কোনো ভালো মানুষ নেই। সবাই হচ্ছে খুনি, ডাকাত, বদমাইশ ও সন্ত্রাসী। তাদের কোনো কিছুকে বিশ্বাস করবে না।’ তাই যখন সিকিউরিটির জন্য দাঁড়ানো হয় তখন শরীরে যা কিছু আছে সব কিছু খুলে আলাদা করে ফেলতে হয়। বেল্ট, ঘড়ি, জুতা, জ্যাকেট, মোবাইল ফোন, চাবির রিং, খুচরা পয়সা, ল্যাপটপ, মানিব্যাগ কিছুই সঙ্গে রাখা যাবে না। সেগুলো বাস্কেটে করে এক্স-রে করতে পাঠানো হয়। কিছু ভয়ংকর জিনিস আছে, যেগুলো দেখলে সিকিউরিটির মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, তার একটি হচ্ছে পানি!

সিকিউরিটিতে কাজ করতে করতে মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই অমানুষ হয়ে যায়। এবার আমি সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি। কারণ এবার আমি যখন এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তখন আমাদের সঙ্গে একটি ছয় মাসের শিশু ছিল। তাকে আলাদা করে রাখতে হলো এবং ডাকাতের মতো একজন মানুষ তাকে টিপেটুপে দেখল, সে গোপনে কোনো অস্ত্র নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে কি না। শুধু তা-ই নয়, টিপেটুপেই তারা নিঃসন্দেহ হলো না, মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তাকে আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখল, আসলে শিশুটি বড় কোনো সন্ত্রাসী কি না। যে চাকরিতে ছয় মাসের অবোধ শিশুকে সন্দেহ করতে হয়, সেই চাকরি না করলে কী হয়?

তবে পৃথিবীর দুটি এয়ারপোর্টে আমি এখনো যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করি, তার একটি হচ্ছে ঢাকা এয়ারপোর্ট। এখানে সবাই আমাকে চেনেন এবং ‘স্যার এইখানে চলে আসেন’ বলে ডেকে নিজ থেকে সব কিছু করে দেন। শুধু তা-ই নয়, পাসপোর্টে সিল দেয়ার সময় অনেকেই তাঁদের ছেলে-মেয়ের গল্প করেন, আমার লেখালেখি পড়তে তাঁরা ভালোবাসেন—সেই কথাটি জানিয়ে দেন।

দ্বিতীয় যে এয়ারপোর্টে আমি যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করি, সেটি হচ্ছে নিউ ইয়র্কের এয়ারপোর্ট। এখানেও বাঙালি পুলিশ অফিসার ইমিগ্রেশনের লাইনে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরাও আমাকে চিনে ফেলেন এবং আলাদাভাবে সাহায্য করেন। কাজ শেষ হওয়ার পর তাঁরা আমার সঙ্গে একটি সেলফিও তুলে ফেলেন। আমাদের সঙ্গে যেহেতু একটি ছোট শিশু ছিল, তাই এয়ারপোর্টের অপরিচিত মানুষরাও নিজ থেকে এগিয়ে এসে আমাদের সাহায্য করে। যেখানে মানুষজন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে আমাদের কখনো লাইনে দাঁড়াতে হয় না। ছোট শিশুকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হিসেবে না দেখে ছোট শিশু হিসেবেই দেখার মধ্যে নিশ্চয়ই এক ধরনের আনন্দ আছে, অন্য এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির মানুষরা কখনোই সেই আনন্দটি উপভোগ করতে পারে না।

নিউ ইয়র্ক শহরটি নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ শহর। যারা এই শহরে থেকেছে কিংবা ঘুরতে এসেছে, সবাই এটি স্বীকার করবে। একেকজন মানুষের কাছে শহরটিকে একেকটি কারণে চমকপ্রদ মনে হতে পারে; যেমন—আমার কাছে এই শহরকে চমকপ্রদ মনে হওয়ার অনেক কারণের একটি হচ্ছে, এখানকার মানুষের শরীরের উল্কি (tattoo)! শীতকালে জাব্বাজোব্বা পরে শরীর ঢেকে রাখতে হয় বলে বেশির ভাগ সময় উল্কি দেখা যায় না। গ্রীষ্মে বা গরমের সময় এখানকার মানুষের উল্কি উপভোগ করা যায়। শৈশবে শুধু এক রঙের উল্কি দেখেছি; কিন্তু উল্কি যে কত বিচিত্র রঙের হতে পারে এবং কত নান্দনিক হতে পারে, সেটি এখানে না এলে কেউ অনুমান করতে পারবে না।

তবে যে কারণে নিউ ইয়র্ক শহর সম্ভবত সারা পৃথিবীর সব শহর থেকে আলাদা করা যায় সেটি হচ্ছে এখানকার মানুষের বৈচিত্র্যে (Diversity)। শহরটি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যদি শুধু তাদের মুখের কথা শোনার চেষ্টা করা হয়, তাহলে অবাক হয়ে আবিষ্কার করা যায় কত বিচিত্র এখানকার মানুষের মুখের ভাষা! আমি মিনিট দশেক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মানুষজনকে যেতে দেখেছি। এর মধ্যে দুজন বাঙালি মহিলাকে খাঁটি সিলেটি ভাষায় কথা বলতে বলতে হেঁটে যেতে দেখলাম। আমার ধারণা, যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় যদি মানুষজনকে লক্ষ করা যায়, তাহলে বেশির ভাগ সময় দেখা যাবে তারা ইংরেজি নয়, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় কথা বলছে।
আমি যেদিন লেখাটি লিখছি সেদিন যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকশন হচ্ছে। আমাদের দেশে ইলেকশন বিশাল একটি ঘটনা। দেশে এখনো প্রার্থীদের নমিনেশন দেয়া হয়নি; কিন্তু মনে হয় পুরো দেশ মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পোস্টারে ঢেকে গেছে। ইলেকশনের দিন দেশের মানুষ সেজেগুজে ভোট দিতে আসে। কত মানুষ ভোট দিয়েছে জানার জন্য ইন্টারনেটে খোঁজ করেছিলাম, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৮০ ভাগ ভোটার ভোট দেয়। আমেরিকায় সেই সংখ্যাটি মাত্র ৫৫ ভাগ। কাজেই এ দেশের মানুষকে ভোট দেয়ানোর জন্য অনেক চেষ্টাচরিত্র করা হয়। খুব যে লাভ হয়, তা মনে হয় না।

সকালে আমি একজন ভোটারের সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলাম। মানুষকে ভোট দিতে উৎসাহী করার জন্য পুরো ব্যাপারটি খুবই সহজ করে রাখা হয়েছে। গিয়ে নিজের নাম বললেই তাকে একটি ব্যালট পেপার দেওয়া হচ্ছে। ভোট দেওয়ার নিয়ম-কানুন কমপক্ষে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লেখা আছে। এর মধ্যে বাংলাও আছে। পাশাপাশি অনেক ডেস্কে মানুষজন আলাপ-আলোচনা করে ব্যালটে টিক চিহ্ন দিচ্ছে। টিক চিহ্ন দেওয়ার পর স্ক্যানারে স্ক্যান করে ভোটার ভোটকেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসছে। মানুষ যেহেতু ভোট দেয় না, তাই যারা কষ্ট করে ভোট দিতে আসে, তাদের একটি স্টিকার দেওয়া হয়। সেখানে লেখা ‘আমি ভোট দিয়েছি’। সেটি বুকে লাগিয়ে গর্বিত ভোটার ঘুরে বেড়ায়।

তবে যারা এ দেশে স্থায়ীভাবে থাকে তারা আমাকে বারবার সতর্ক করে বলেছে, আমি যেন নিউ ইয়র্ককে দেখে সারা আমেরিকা সম্পর্কে একটি ধারণা করার চেষ্টা না করি। নিউ ইয়র্ক শহরটি পুরোপুরি অন্য রকম। এখানে পুলিশ কোনো মানুষকে ধরে কখনোই জানতে চাইতে পারবে না তার কী কাগজপত্র ঠিক আছে কি না। এ দেশের অনেক জায়গা আছে, যেখানে কালো বা দরিদ্র মানুষ যেন ভোট দেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে সে জন্য পুরো প্রক্রিয়াকে কঠিন করে রাখা আছে। ভোটার তালিকায় নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিবছর ভোটকেন্দ্র পাল্টানো হয়। নানা রকম আইডি দেখিয়ে ব্যালট নিতে হয়। লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এবং কিছুদিনের ভেতরেই দরিদ্র মানুষ ভোট দেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।

যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত গণতন্ত্রের কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। এ দেশে এক ধরনের গণতন্ত্র নিশ্চয়ই আছে, তা না হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একটি ‘উৎকট রসিক’ কেমন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন? আমার ধারণা ছিল, এবারকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দলটিকে এ দেশের মানুষ বিদায় করে দেবে। সেটি হয়নি। কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ এখনো ডোনাল্ড ট্রাম্পের দখলে। নিম্নকক্ষটি তাঁর হাতছাড়া হয়েছে। এবার আমি আগ্রহ নিয়ে দেখার চেষ্টা করব একজন প্রবলভাবে মিথ্যাচারী, হিংসুটে, প্রতিহিংসাপরায়ণ, পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণাপরায়ণ প্রেসিডেন্টকে একটুখানি হলেও আটকে রাখা যায় কি না। যদি সে রকম কিছু ঘটে, তাহলে এ দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটুখানি হলেও বিশ্বাস ফিরে আসবে।

আমাদের দেশেও নির্বাচন আসছে। দেশের বাইরে থেকে ইন্টারনেটে দেশের সব খবর পেয়ে গেলেও দেশটিকে অনুভব করা যায় না। নির্বাচন নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো না, ঠিক কী কারণ জানা নেই। শুধু মনে হয় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিভাবে একটি লাশ ফেলে দেয়া যায় সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে আমি একচক্ষু হরিণের মতো, আমি জটিল রাজনীতিকে খুব সহজ করে বুঝতে চাই। যেহেতু এ দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, তাই এ দেশের সব রাজনীতি হতে হবে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো সেটি মুখে স্পষ্ট করে উচ্চারণ না করবে, আমি সেই রাজনৈতিক দলটিকে বিশ্বাস করতে পারি না। বিএনপি এখনো মুখে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেনি তারা নির্বাচন করবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়া, যে কারণে বিকল্পধারা তাদের সঙ্গে ফ্রন্ট করেনি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন বর্ষীয়ান নেতা ড. কামাল হোসেনের কাছে বিষয়টি সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে আগ্রহী নন। সম্ভবত এটিকেই রাজনীতি বলে। আমি সেই রাজনীতি চোখ দিয়ে দেখব; কিন্তু মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে?

Share this news on:

সর্বশেষ

img
প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে সিনেমা শেখাতে চান আমির Sep 15, 2025
img
শেখ হাসিনার মামলায় আর দু’একজনের সাক্ষ্য নেয়া হবে: চিফ প্রসিকিউটর Sep 15, 2025
img
মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে ১১ হাজার টন ইলিশ Sep 15, 2025
img
আওয়ামী লীগ আর হিন্দুস্তান একই পথের সাথী: জয়নুল আবদিন ফারুক Sep 15, 2025
“মানুষ সচেতন না হলে, পাসপোর্ট অফিসের দালাল থামবে না!” Sep 15, 2025
img
আপেলের সঙ্গে কমলার তুলনা, ‘সাইয়ারা’ প্রসঙ্গে আমিশা পাটেল Sep 15, 2025
img
পদোন্নতি পাওয়া পুলিশের ৬২ কর্মকর্তাকে একযোগে পদায়ন Sep 15, 2025
img
আ. লীগ ফিরে এলে তোমাদের হাড্ডিও খুঁজে পাওয়া যাবে না : ইলিয়াস Sep 15, 2025
img
শপথ নিলেন নেপালে সুশীলা কার্কির ৩ মন্ত্রী Sep 15, 2025
img
আজানের শব্দে কবর থেকে নড়ে উঠলো নবজাতক, পরিবার পলাতক Sep 15, 2025
img
ইতালিতে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শিকার হন সোহা আলি খান Sep 15, 2025
নবুওয়াতের আগে নবীজির ব্যক্তিত্ব | ইসলামিক জ্ঞান Sep 15, 2025
নবীজির বিয়ের ঘটনা | ইসলামিক জ্ঞান Sep 15, 2025
এবার আইটেম গানে ধরা দেবেন সামিরা খান মাহি Sep 15, 2025
পাকিস্তানের দিকে ফিরেও তাকালেন না ভারতীয় ক্রিকেটাররা Sep 15, 2025
'এয়ার এস্ট্রায় যাত্রীর তিক্ত অভিজ্ঞতা Sep 15, 2025
আফতাবনগর ও বনশ্রীতে যুক্ত হচ্ছে ৩ সেতু! এলাকাবাসীর স্বপ্ন পূরণ! Sep 15, 2025
img
রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বাড়লো ৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস Sep 15, 2025
নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয় কাজের আহ্বান জানালেন এমপি মনোনয়ন প্রার্থী রেজাউল Sep 15, 2025
বেটিং অ্যাপ কেলেঙ্কারিতে এবার মিমি-উর্বশীর নাম Sep 15, 2025