অভ্র’র মেহেদীকে থামাতে চেয়েছিলেন মোস্তফা জব্বার?

অভ্র কি-বোর্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মেহেদী হাসানকে থামাতে চেয়েছিলেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার। এনেছিলেন পাইরেসির অভিযোগ। একের পর এক উকিল নোটিশ পাঠিয়ে হয়রানি করেছিলেন অভ্র কিবোর্ড সফটওয়্যারটির প্রতিষ্ঠাতাদের। এমন তথ্য উঠে এসেছে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়, অভ্র সফটওয়্যারের আগে বাংলা লিখতে ব্যবহার হতো মোস্তফা জব্বারের বিজয় কিবোর্ডটি। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাজারে আনা হয় বিজয় কিবোর্ড। আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী হিসেবে পরের বছরই সেটিকে কপিরাইট করিয়ে নেন মোস্তফা জব্বার। বিজয়কে বাজারজাত করেন বাণিজ্যিক সফটওয়্যার হিসেবে। এতে বাংলা লিখতে গেলে ব্যবহারকারীদের গুণতে হতো মোটা অংকের টাকা।

বাংলা কিবোর্ড ব্যবহারকারীদের জন্য ২০০৩ সালে বিনামূল্যের কিবোর্ড প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন মেহেদী হাসান। শুরুতে কেবল টেকনিক্যাল সমস্যা সমাধানের জন্য ফোরাম তৈরি করলেও ধীরে ধীরে সেখান থেকেই পূর্ণাঙ্গ যাত্রা করে অভ্র কিবোর্ড। ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’- প্রতিপাদ্য নিয়ে ফ্রি সফটওয়ার হিসেবে বাজারজাত করা হয় অভ্র সফটওয়্যারটিকে। অর্থাৎ এটাকে বিনামূল্যে ইচ্ছেমত ব্যবহার ও বিতরণ করা যায়।

প্রথম দিকে অভ্রর চেয়ে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে বিজয়কে প্রাধান্য দেয়া হলেও দ্রুতই বিজয়কে পেছনে ফেলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে মেহেদী হাসান খানের অভ্র কিবোর্ড। ফোনেটিক লে আউটের কারণে সহজেই ইংরেজি কিবোর্ড ব্যবহার করে বাংলা লেখার সুবিধার কারণে মোবাইল কিবোর্ড হিসেবে পছন্দের তালিকার শীর্ষে উঠে আসে অভ্র। এছাড়া ইউনি বিজয় ব্যবহার করে বিজয় কিবোর্ডের সুবিধা পাওয়ায় মোস্তফা জব্বারের বিজয় ব্যভারকারীরাও অভ্র ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন।

বিপত্তির শুরু হয় এখানেই। ২০১০ সালে প্রথম অভ্র কি-বোর্ড বা সফটওয়্যারটি মোস্তফা জব্বারের রোষানলে পড়ে। হাসিনা সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে জব্বার ইঙ্গিত করেন, হ্যাকাররা তার 'বিজয়' সফটওয়্যারটি চুরি করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংবাদপত্রের এক নিবন্ধে তিনি অভ্র কিবোর্ডকে পাইরেটেড সফটওয়্যার হিসেবে উল্লেখ করেন।

এখানেই থেমে যাননি সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার। অভ্র ও মেহেদী হাসানকে দমাতে অভিযোগ করেন, জাতীয় তথ্য ভান্ডার তৈরির কাজে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পে বাণিজ্যিক বিজয় সফটওয়্যারের পরিবর্তে বিনামূল্যের অভ্র ব্যবহার করার কারণে সরকারের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন জব্বার।

সে সময় গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন ব্লগে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলে। অনেকের লেখায় বলা হয়, ক্রমাগত হুমকি, উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছিল বিনামূল্যের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান অভ্রকে। এক পর্যায়ে বিজয়ের স্বত্বাধিকারী হিসেবে অভ্র’র বিরুদ্ধে কপিরাইট অফিসে আইন ভঙ্গের অভিযোগ করেন জব্বার।

তার দাবি, অভ্র সফটওয়্যারের সাথে ইউনি বিজয় নামে যে কি-বোর্ডের লে-আউট সরবরাহ করা হয়, এটি প্যাটেন্টকৃত বিজয় কি-বোর্ড লে আউটের নকল। এই অভিযোগের ভিত্তিতে কপিরাইট অফিস মেহদী হাসান খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়। ওই নোটিশের পর সময় চেয়ে আবেদন করেন মেহেদী হাসান। তাকে ২০১০ সালের ২৩ মে পর্যন্ত সময় দেয়া হয়। পরবর্তীতে ঢাকার আগারগাঁও এ অবস্থিত বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল অফিসে মেহদী হাসান খান ও মোস্তাফা জব্বারের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়।

অভ্রের আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা তানবীন ইসলাম সিয়াম জানান, আইনি নোটিশের পর অভ্র কি-বোর্ড থেকে ইউনি বিজয় দিয়ে লেখার লে-আউট সরিয়ে ফেলা হয়। যারা বিজয় থেকে ইউনিকোডে টাইপ করতে পারতেন না তাদের সুবিধার জন্যই ওই লে-আউট তৈরি করা হয়েছিল। মোস্তফা জব্বারের বিজয় কিবোর্ডের সঙ্গে কিছু অংশে মিল থাকলেও দুটি কখনোই এক ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি। অভিযোগকারী পক্ষের সাথে সমঝোতার পর অভ্রর পরবর্তী ভার্সনে আর লে আউট রাখা হয়নি। বলেও নিশ্চিত করেন তানবীন।

এতসব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়েও অভ্রর জনপ্রিয়তায় আঁচ লাগেনি। এগিয়ে গেছে বুক চেতিয়ে। ঠিক তার শিরোনামের মতোই উন্মুক্ত ও বিনামূল্যে ছড়িয়ে দিয়েছে বাংলা লেখার সহজ কিবোর্ডটিকে। তারই সম্মানে এবারের একুশে পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে অভ্রর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মেহেদী হাসান খানকে। তবে তিনি একা সে পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় দলগতভাবে মেহেদী হাসানের চার সহযোগীকে একুশে পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার।

টিএ/

Share this news on: