জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে হাসিনার বিচারের দলিল মনে করছে সরকার


জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার অনুরোধে শক্ত সমর্থন হিসেবে কাজ করবে। আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করতে প্রতিবেদনটি কাজে লাগবে বলে ধারণা করছে সরকার।

জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান ফলকার তুর্ক গত বুধবার জেনেভা থেকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে জুলাই-আগস্টে সুপরিকল্পিত ও পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটানো হয়। ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। নিহতদের ১২ থেকে ১৩ শতাংশ (অন্তত ১৮০ জন) ছিল শিশু। গ্রেপ্তার করা হয় ১১ হাজার ৭০২ জনকে। ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ ও তদারকিতে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম গতকাল ট্রাইব্যুনালে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিচারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি অকাট্য দলিল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো মারণাস্ত্রসহ একটি জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর বিপক্ষে প্রতিবেদনটি একটা সুস্পষ্ট ও অকাট্য দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে ব্যবহার করা যাবে।

জুলাই-আগস্টের হত্যা, নৃশংসতার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে প্রামাণ্য দলিল মনে করছেন অন্তর্বর্তী সরকারসংশ্লিষ্ট ও বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অনেকে। সরকারের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই প্রতিবেদন শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে ভারত থেকে ফেরানোর অনুরোধে শক্ত সমর্থন হিসেবে কাজ করবে।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপি দলটির ৮৪৮ নেতা-কর্মী হত্যার অভিযোগ দায়ের করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগে শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে।
সরকারের কর্মকর্তারা মনে করছেন, শেখ হাসিনাকে তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলায় বিচারের মুখোমুখি করতে ফেরত চেয়ে ভারতের কাছে যে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানো হয়েছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদন সেই অনুরোধের পক্ষে শক্ত সমর্থন হিসেবেও কাজে লাগবে। এ কারণে তাঁকে ফেরত দিতে ভারতকে আবারও তাগিদ দেওয়ার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘের উদ্বেগ শুধু মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। মৃত্যুদণ্ড যদি দেওয়াও হয়, সেটা যাতে স্থগিত রাখা হয়, এ রকম একটা প্রস্তাব করেছে। এসব বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কাছে ক্ষমতা আছে, তাঁরা কী ধরনের দণ্ড দেবেন, কী দেবেন না, সেটা পরে দেখা যাবে।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি মহল দাবি জানালেও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ করা হয়েছে।
অনেকের মতে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপার আছে। আওয়ামী লীগের বাইরে প্রধান দল বিএনপি এ ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধায় আছে। এসব কারণে সরকার এ বিষয়ে ধীরে চলতে পারে। তবে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি কাজে লাগিয়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করা যেতে পারে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে দলগতভাবে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই অপরাধে দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ স্থানীয় আইনে আছে। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যা, গুমসহ বিভিন্ন অভিযোগে দেশে বিভিন্ন আদালতে ২৫০টির মতো মামলা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য দেশে ফেরানো প্রসঙ্গে এত দিন বিএনপি সরাসরি কিছু না বললেও গতকাল দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা চাই ভারত সরকার তাঁকে (হাসিনা) ...বাংলাদেশ সরকারের হাতে দেবে।’ শেখ হাসিনা ছাড়াও তাঁর সহযোগীদেরও সরকার বিচারের আওতায় আনবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ভারতকে গত ২২ ডিসেম্বর কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়। এর জবাব গতকাল পর্যন্ত আসেনি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের উল্লেখ করে সরকার এখন তাঁকে ফেরত দিতে ভারতকে তাগিদ দেবে কি না, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম গতকাল বলেন, প্রতিবেদনের যা প্রকাশ করা হয়েছে, তা যে কাউকে নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। শেখ হাসিনাকে ফেরানোর বিষয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয় ধরনের ব্যাপার আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের জবাবের জন্য সরকার আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারে। তবে সঠিক সময়ে এ বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হবে।


Share this news on:

সর্বশেষ

img
গার্দিওলাকে ক্লাব ছাড়া নিয়ে কিছুই বলেননি সাভিনিয়ো ও এডারসন Aug 16, 2025
img
বিপ্লবের পথ আমরা হারিয়ে ফেলেছি : রেজা কিবরিয়া Aug 16, 2025
img
শেখ মুজিব আর শেখ হাসিনাকে এক করে দেখবেন না : কাদের সিদ্দিকী Aug 16, 2025
img
ডাকসুর কোন পদে নির্বাচন করবেন তন্বি? Aug 16, 2025
img
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায় এনসিপি Aug 16, 2025
img
আলোচনায় নতুন সংবিধান না হলে, রাজপথে নামতে দেরি করব না : আখতার Aug 16, 2025
img
বঙ্গোপসাগরে ফের লঘুচাপ সৃষ্টির আভাস Aug 16, 2025
img
ভালোবাসারে কেউ ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’: সায়ান Aug 16, 2025
img
বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের সূচি প্রকাশ করল আফগানিস্তান Aug 16, 2025
img
ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের বার্তা Aug 16, 2025
হৃতিক, আদিত্যর পর এবার কঙ্গনার ব্যক্তিগত জীবনের অজানা অধ্যায় ফাঁস! Aug 16, 2025
img
হাসনাত-সারজিসসহ ৫ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রত্যাহার Aug 16, 2025
img
১০ ফুটবলারকে ছাড়েনি বসুন্ধরা কিংস, জরুরি সভা বাফুফের Aug 16, 2025
প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাকিস্তানে নিহত ৩০০-এর বেশি Aug 16, 2025
নতুন চেতনায় পুরনো ভয়! রিজভীর মন্তব্যে রাজনীতিতে আলোচনার ঝড় Aug 16, 2025
বেসরকারি হাসপাতাল-মালিকদের লাভের অংশ পুনঃবিনিয়োগের আহবান আইন উপদেষ্টার Aug 16, 2025
img
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৮ দফা অঙ্গীকারনামা Aug 16, 2025
img
গোপালগঞ্জ নয়, দেশের প্রথম ভ্যাকসিন প্লান্ট হবে মুন্সীগঞ্জে : স্বাস্থ্য উপদেষ্টা Aug 16, 2025
img
ট্রাম্প ও পুতিন বৈঠকের পরই ইউক্রেনে ড্রোন হামলা চালাল রুশ বাহিনী Aug 16, 2025
img
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শক্তিশালী শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে : প্রিন্স Aug 16, 2025