থ্যালাসেমিয়ার বিপদ থেকে বাঁচতে, জানতে হবে সবার আগে

ধরুন আপনি সমতলের বাসিন্দা। প্রথমবারের মতো সাগর দেখতে গেছেন। লোকালয় থেকে একটু দূরে বালুকাময় সৈকতে একা একা খালি পায়ে হাঁটছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি জনমানুষ শূন্য সৈকতে চলে আসলেন হেঁটে হেঁটে। একসময় ভাবলেন পা ভিজিয়ে হাঁটলে তো মন্দ হয় না। ভালোই উপভোগ করছিলেন। হঠাৎ আপনার কাছে মনে হলো সাগরের আওয়াজ আর ঢেউয়ের গতিপ্রকৃতি একটু কেমন কেমন। আপনি মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়ে হাঁটায় মনোযোগ দিলেন। আরেকটু পানিতে নামলেই বা কি এমন হবে। একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে সাগর। নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে হলো আপনার। মনে পড়তে লাগলো অতীতের কত স্মৃতি। হঠাৎ খেয়াল করলেন কেউ একজন আপনাকে কি যেন বলতে বলতে দৌড়ে আপনার দিকেই আসছে। হাত নাড়ছে। এটা কি কোনো বিপদসংকেত? লোকটা কি ছিনতাইকারী  কেউ হবে? ডান হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে দেখলেন ফোনটা ঠিক আছে কিনা? আছে তো। লোকটা কি তাহলে ফোনের জন্যই আসছে? শোনার চেষ্টা করলেন কি বলছে। কিন্তু ওর ভাষাটা ঠিক আপনার বোধগম্য হলো না। লোকটি বোধহয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা বড় ঢেউয়ের ঝাপটা এসে আপনাকে ডুবিয়ে দিল। ক্ষণিক পরেই আপনি দেখলেন আপনি অথৈ সাগরে ভাসছেন।

এই কাল্পনিক দৃশ্যে লোকটির দুর্দশার কারণ ছিল সাগর সম্পর্কে তার অজ্ঞতা। সাগরে আসার আগে কখন জোয়ার হবে, কখন ভাটা হবে এসব জেনে আসেননি। সৈকতে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তাও খেয়াল করেননি বা এড়িয়ে গেছেন। একটু সতর্ক হলেই এ রকম বিপদ এড়িয়ে যাওয়া যায়। শুধুমাত্র সঠিক তথ্য না জানার কারণে আমরা অনেক সময় শুধু নিজেদেরই না আমাদের অনাগত সন্তানকেও বিপদে ফেলে দিই। এমনই একটি বিপদের নাম থ্যালাসেমিয়া।

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তরোগ। এই রোগের বংশগতি প্রচ্ছন্ন ধরনের। কারণ এ রোগ হতে হলে দুটি জীনই ত্রুটিপূর্ণ হতে হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের সকল জিনের দুইটি করে কপি থাকে। এখন কারোর যদি একটি জীন ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলে কি হবে? একটি জীন ত্রুটিপূর্ণ হলে সে ব্যক্তিকে বলে বাহক। এক্ষেত্রে বিড়ম্বনা হলো, একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারেন। তার মানে আমি, আপনি বা যেকোনো সুস্থ মানুষই বাহক হতে পারি। আর দুজন বাহক এর মধ্যে বিয়ে হলেই আমাদের অনাগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হবার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ, বাহক হবার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ এবং সুস্থ হবার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। এ কারণেই আমরা বাহক কিনা তা জেনে নেয়া জরুরি।

অন্যদিকে দুজনের মধ্যে একজন যদি ত্রুটিপূর্ণ জীনের বাহক হয় এবং অন্যজন বাহক না হয় তাহলে আপনার সন্তান ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাহক হতে পারে, ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ (কোন ত্রুটিপূর্ণ জীন থাকবে না)। কাজেই কেউ বাহক হলে তাকে হেয় করার কোনো সুযোগ নেই।

এখন জেনে নেয়া যাক কারো যদি দুটি জীনই ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলে ঐ ব্যক্তিটির দেহে কি ঘটে। সেক্ষেত্রে থ্যালাসেমিক ব্যক্তির হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষ অনেক কমে যায়। হিমোগ্লোবিন হলো একটি প্রোটিন যা চারটি ইউনিট নিয়ে গঠিত। ত্রুটিপূর্ণ জীন থাকার দরুন হিমোগ্লোবিনের দুটি বিটা চেইন তৈরি হয় না বা কম তৈরি হয়। ফলে দেহে অক্সিজেন এর সংবহন কমে যায়। যার প্রভাবে আমাদের বেঁচে থাকার ও শারীরিক শক্তির জন্য বিপাকীয় কার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। তখন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বেঁচে থাকতে হলে অন্যের কাছ থেকে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়।

কয়েকমাস আগে আমি বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখন একজন স্কুল পড়ুয়া থ্যালাসেমিক শিশুর সাথে কথা হয়। তার কাছে জীবনের মানে অন্যরকম। তার প্রতিমাসে কয়েকবার রক্ত নিতে হয়। তার জন্য রক্তদাতা খোঁজতে হয়। তার ওপর আছে নানা ধরনের জটিলতা। আর বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই এসব নিয়ে উৎকণ্ঠায় সময় পার করে। অনেক সময় শরীরে কোনো শক্তিও থাকে না। তার মধ্যেও সে পড়তে বসে। তার চোখে একটাই স্বপ্ন সে চায় তার মতো যাপিত জীবন যেন আর কাউকে যাপন করতে না হয়। সে আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা বিষয়ক স্টাডিতে অংশ নিতে চায়। তার নিজের কথা বলতে চায়, যেন আর একটি শিশুও থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম না নেয়।

সবশেষে, আজ ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। একটি থ্যালাসেমিয়া মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের সবাইকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে যার যার অবস্থান থেকে। সঠিক তথ্যটি পাশের মানুষটিকে জানাতে হবে যেন সে নিজেই সচেতন হয়। বাংলাদেশে এখন খুব সহজেই হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিসের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করা যায়। আসুন নিজে বাহক কিনা সেটা আগে জানি। অন্যকে জানতে উৎসাহিত করি। সে অনুযায়ী জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পরামর্শ দেই।

 

লেখক:

মো. মাহবুব হাসান

সহকারী অধ্যাপক

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইলmahbub.hasan@cu.ac.bd

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ইন্ডাস্ট্রি আমাকে ইউজ করেনি, করতেই পারত : ইন্দ্রানী দত্ত Nov 02, 2025
img
নিজের মূল্যবোধে অটল অভিনেত্রী ইশা সাহা Nov 02, 2025
img
জন্মদিনে কিং খানকে শুভেচ্ছা বার্তা মমতা ব্যানার্জির Nov 02, 2025
img
সমাজে অভিনেত্রীর ভুল ধারণা বদলাতে হবে : ঋতাভরী চক্রবর্তী Nov 02, 2025
img
স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত ছাত্রদল : এ্যানি Nov 02, 2025
img
নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে বৃষ্টির হানা, আছে রিজার্ভ ডে Nov 02, 2025
img
মায়ের শিক্ষা থেকে গড়ে উঠেছে মিমি দত্তের দৃঢ় মনোভাব Nov 02, 2025
img
প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা কলি’ নিতে সম্মত এনসিপি, জানালেন পাটওয়ারী Nov 02, 2025
img
সমালোচনার মধ্যেও অভিনয়ে অরিজিতার দৃঢ়তা Nov 02, 2025
আবারও নেতৃত্বে নাজমুল হোসেন শান্ত Nov 02, 2025
img
সিডনির হাসপাতাল থেকে ফিরলেন শ্রেয়াস আইয়ার Nov 02, 2025
দেশের বাজারে আবারও বেড়েছে পেঁয়াজের ঝাঁঝ! Nov 02, 2025
আওয়ামী লীগের বিষয়ে যে মন্তব্য করলেন মাসুদ কামাল Nov 02, 2025
হানিফ ও ইনুর মামলায় ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি Nov 02, 2025
img

নাহিদ ইসলাম

প্রেসিডেন্ট চুপ্পুর আদেশ হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কফিনে শেষ পেরেক Nov 02, 2025
img
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, ১ দিনে ডিএমপির ৮৬৭ মামলা Nov 02, 2025
img
নিবন্ধন ফিরে পেল জাগপা Nov 02, 2025
img
ইসির সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে এনসিপি Nov 02, 2025
img
ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি দিনই এখন হ্যালোইন: ওবামা Nov 02, 2025
img
লেভারকুজেনকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন মিউনিখ Nov 02, 2025