অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, বিচারের ক্ষেত্রে বিলম্বের যে কারণগুলো, সেগুলো দূর করার চেষ্টা করছে সরকার। শুক্রবার (১৪ মার্চ) দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানান।
সাক্ষাৎকারে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা আট বছরের শিশু আছিয়ার বিচারের প্রসঙ্গেও কথা বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, তাড়াহুড়া করে মামলা নিষ্পত্তি হলে অবিচার হতে পারে, অপপ্রয়োগ হতে পারে, এই আশঙ্কা তো সব সময়ই থাকে।
আমাদের বিদ্যমান আইনে থাকা ১৮০ দিনকে কমিয়ে আমি ৯০ দিন করার কথা বলেছি। ১৮০ দিনও অনেকের কাছে মনে হবে তাড়াহুড়া। এটা করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরো কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি। শুধু বিচারের সময় কমিয়ে দিলাম, সেটা নয়; বিচারের ক্ষেত্রে বিলম্বের যে কারণগুলো, সেগুলো আমরা দূর করার চেষ্টা করছি। আইনে এ ধরনের কিছু বিধানও রাখা হয়েছে। এরপর যদি দেখা যায় অসুবিধা হচ্ছে, তখন আমরা অন্য চিন্তা করব।
মাগুরার শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, মাগুরায় যে ঘটনা ঘটেছে, সেটার কী ব্যাখ্যা আছে, আমি জানি না। কিভাবে মানুষ এত পাশবিক, নির্মম, অমানবিক, উন্মত্ত হয়ে যায়, এটার কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।
তবে কয়েক বছর ধরে আমার মনে হচ্ছে যে আমাদের সমাজে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। বিশেষ করে অনলাইনে এটা খুব সহজলভ্য হয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন টেলিভিশনে যে সিরিয়াল দেখানো হয়, বিশেষ করে ভারতীয় সিরিয়াল, সেখানে অত্যন্ত অনৈতিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে অনেক গল্প দেখানো হয়। এগুলোর একটা প্রভাব থাকতে পারে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। সেটারও প্রভাব থাকতে পারে।
সব কিছু মিলিয়ে একটা ভয়াবহ অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে যত পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট আছে, সেগুলো বন্ধ করার জোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে শুক্রবার (আজ) থেকে।
আরেকটি প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক তো থাকবেই। কিন্তু আমরা আইনে বলছি, যদি পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য, ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য বা মেডিক্যাল সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে বিচারের যথেষ্ট পরিমাণ উপাদান থাকলে বিচারক যদি মনে করেন এটা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট (যথাযথ), বিচারক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সাধারণভাবে ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে।
কিন্তু বিচারক যদি মনে করেন যে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়াই সম্ভব, তাহলে আমরা এটা বিচারিক বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। মনে রাখতে হবে, ধর্ষণ অপরাধটা বাংলাদেশে বা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় দুই শ-আড়াই শ বছর আগে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। সে সময় কি ডিএনএ পরীক্ষা ছিল? তাহলে ওই সময় বিচার হতো কিভাবে? তারপরও আমরা দেখব, যদি এটার অপপ্রয়োগ হয়, আপিল আদালত তো রইলই।
ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তের জামিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দিনাজপুরে যে জামিনের কথা বলছেন, সেই জামিন হাইকোর্ট থেকে হয়েছিল। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে আপিল করেছি। আপিল বিভাগে এই জামিনটা বাতিল হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবিত আইনে জামিনের বিধান দেওয়া হচ্ছে না।
খসড়ায় বলা আছে, জামিন দেওয়া হবে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর বিচারক বিবেচনা করে দেখবেন, যিনি জামিন পাচ্ছেন, তিনি বিচারকার্যে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন কি না বা ভুক্তভোগীর প্রতি কোনো ভীতিপ্রদ আচরণ করছেন কি না। যদি দেখেন, তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর বাধ্যতামূলকভাবে এটা পরীক্ষা করে দেখে জামিন বাতিল করে দিতে পারবেন।
সম্প্রতি আছিয়ার ধর্ষণ ও মৃত্যুকে ঘিরে সারা দেশ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন-বিক্ষোভ বেশ সোচ্চার হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিচার চেয়ে যাঁরা মাঠে নেমেছেন, তাঁদের ক্ষোভ, কষ্ট ও বেদনা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে হবে, ধর্ষণ কিন্তু ব্যক্তি ও পারিবারিক ক্ষেত্রের একটা অপরাধ। ধর্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটাই দায় হতে পারে, রাষ্ট্র যদি গ্রেপ্তার ও বিচার না করে।
গ্রেপ্তার ও বিচারের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে সরকার তৎপর আছে। মাগুরার ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অত্যন্ত বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা দেখলাম, আজকে (বৃহস্পতিবার) মাগুরার শিশুটি মারা গেছে। আজকেই আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন করেছি।
গ্রেপ্তারকৃতদের পরের দিনই ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে। আমি তো কোথাও গাফিলতি দেখছি না। সে ক্ষেত্রে যাঁরা রাস্তায় আন্দোলন করছেন, তাঁদের একটু বুঝতে হবে যে দাবিটা কী। দাবিটা হচ্ছে গ্রেপ্তার, বিচার ও আইনের উপযুক্ত সংশোধন। সবগুলোই তো আমরা করছি। তাঁরা যদি সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আন্দোলন করে থাকেন, ফাইন। তাঁদের যৌক্তিক আরো কোনো দাবি থাকলে সেগুলো আমরা অবশ্যই শুনব।
আরএইচ/টিএ