নিয়মের বেড়াজালে চবির সমাবর্তন, সাবেক শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পঞ্চম সমাবর্তনে অংশ নিতে পারবেন না জেনে শামস আরেফীন নামের এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ লিখেছেন, মূল সার্টিফিকেটের নিচে লিখে দিতেন ‘সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করা যাবে না’ তাও একটু সান্ত্বনা পেতাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আব্দুর রহিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মূল সার্টিফিকেট তোলার সঙ্গে সমাবর্তনের কি সম্পর্ক? সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এখান থেকেই পড়াশোনা শেষ করেছি। সমাবর্তন আমার অধিকার। এমন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আশা করি কর্তৃপক্ষ এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনবে।

শামস আরেফীন ও আব্দুর রহিমের মতো এমন ক্ষোভ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার সাবেক শিক্ষার্থীর। কারণ অনুষ্ঠাতব্য চবির পঞ্চম সমাবর্তনে অংশ নিতে পারবেন না তারা। সম্প্রতি প্রকাশিত রেজিস্ট্রেশনের নিয়মাবলিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল সনদ নেওয়া সাবেক শিক্ষার্থীরা সমাবর্তনে অংশ নিতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বেশিরভাগ সাবেক শিক্ষার্থী। তারা এ শর্ত বাতিল করে সবাইকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, এ শর্ত নতুন করে যুক্ত হয়েছে এরকম না। প্রত্যেক সমাবর্তনেই এ নিয়ম বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া ২০১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে একসঙ্গে সমাবর্তন আয়োজন বলতে গেলে একপ্রকার অসম্ভব। এসময়ের মধ্যে সনদ উত্তোলন করেনি অন্তত ৫০ হাজার শিক্ষার্থী। তাদের অর্ধেক কিংবা এক তৃতীয়াংশও যদি অংশ নেয় এ সংখ্যা কম না।

শিক্ষার্থীরা জানান, নিয়মে এটাও উল্লেখ রয়েছে দুই বছর পরপর সমাবর্তন আয়োজন করার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি আয়োজন করতে পারেনি। এটি তাদের ব্যর্থতা। এখন সমাবর্তনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে এরকম অজুহাত দেখানো উচিত হচ্ছে না। একসঙ্গে সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে আয়োজন সম্ভব না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভাগ ভাগ করে আয়োজন করতে পারত।

তারা জানান, কালো গাউন, হুড পরে সহপাঠীদের সঙ্গে আকাশে চার কোনা টুপি ওড়ানোর বিশেষ আনন্দ উপভোগ করা প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। কিন্তু গত ১৪ বছর ধরে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ চবি শিক্ষার্থীরা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু সমাবর্তনের জন্য তারিখের পর তারিখ ঘোষণা করেছে। কিন্তু আয়োজন আর আলোর মুখ দেখেনি। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চবি প্রশাসনেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। নতুন কর্তাদের প্রতি সাবেক শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল সমাবর্তন আয়োজনের। কর্তৃপক্ষও সেই পথে হাঁটে। সমাবর্তনের তারিখ ঘোষণার পর রেজিস্ট্রেশনের কার্যক্রম শুরুরও উদ্যোগ নেওয়া হয়।

চবির সাবেক শিক্ষার্থী দিদারুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সমাবর্তন আয়োজন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা একপ্রকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাই তারা নানা প্রয়োজনে মূল সনদ উত্তোলন করে ফেলেছেন। আবার সাবেক শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ জানেই না মূল সনদ উত্তোলন করে ফেললে সমাবর্তনে অংশ নেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এটির সমাধান বের করে সবাইকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় সহপাঠীদের অনেককে বাদ দিয়ে আমাদের সমাবর্তনে অংশ নেওয়া উচিত হবে না।

জানতে চাইলে চবি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, যারা মূল সনদ তুলে ফেলেন, তারা সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়ম। সবসময় এটা মেনে চলা হয়। যারা সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে চায়, তারা মূলত প্রবেশনারি সনদ নেয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন নিয়মিত হয় না বলে শিক্ষার্থীরা মূল সনদ তুলে ফেলেন। তবে সমাবর্তন নিয়মিত না হওয়ার দায়ভার বর্তমান প্রশাসন নেবে না। আমরা ২০১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত সময়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমাবর্তনের আয়োজন করছি। এটা নিয়ে তো সবার প্রশংসা করা উচিত। অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছিল ২০১৫ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত করার। কিন্তু তারপরও হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সনদ তৈরি করে আমরা বড় একটি সমাবর্তনের আয়োজন করছি।

বর্তমান প্রশাসন নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজন করবে কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই আমরা নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজন করব। আমরা তো আগেই ঘোষণা দিয়েছি যে দুই বছর পরপর সমাবর্তনের আয়োজন করা হবে।

চবির পঞ্চম সমাবর্তন উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, আমরা এটা নিয়ে ছাত্র ও সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার বসব। আমাদের লিমিটেশন আছে, আমরা কতজনকে নিয়ে এ সমাবর্তন আয়োজন করব। আমরা হিসাব করে দেখেছি ২০১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী সনদ নেয়নি। এর মধ্যে যদি এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে, তাহলে ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। এ পর্যন্ত যতগুলো সমাবর্তন হয়েছে সবগুলো ৭-৮ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে। এত বড় আয়োজন করতে গিয়ে সব শিক্ষার্থীকে আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য যারা সনদ নেয়নি তারা শুধু অংশগ্রহণ করতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের এই আবেগের সঙ্গে আমি একমত। আমি এ বিষয়ে উপাচার্য স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। আর আমাদের সমাবর্তন উদযাপন কমিটি রয়েছে, সেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা করব। আমরা চাই সবাইকে দিতে কিন্তু আমরা সবাইকে দিতে পারব কি না, এটা বড় প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে সবাইকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিলাম কিন্তু আপ্যায়ন করতে পারলাম না।

আগামী ১৪ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে। এতে ২০১১-২০২৩ পর্যন্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে ১৫ মার্চ।

চবিতে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর দ্বিতীয়টি ১৯৯৯ সালে, তৃতীয়টি ২০০৮ সালে এবং চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে।


এমআর

Share this news on: