প্রতি বছর বিশেষ করে গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে উৎসবমুখর পরিবেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঈদ উদযাপন করেছেন। তবে এবারের পরিস্থিতি পুরোটাই উল্টো৷ গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিন কাটছে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে৷
দলটির নেতাকর্মীদের অধিকাংশ রয়েছেন আত্মগোপনে, কেউ দেশে কেউ দেশের বাইরে।
দেশে থেকেও অনেকে পরিবারের অন্যানা সদস্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন৷ অনেকে আবার পরিবারের সঙ্গে থাকলেও প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না বা স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছেন না৷ এই পরিস্থিতিতে তাদের এবারের ঈদুল ফিতরের উৎসব প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়েই পার করতে হবে৷ এবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঈদ আনন্দ-উৎসবের পরিবর্তে নিরানন্দেই কাটবে৷ আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে৷
আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপি সবাই আত্মগোপনে৷ কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বেশিরভাগই দেশ ছেড়েছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়েরও অনেক নেতা দেশের বাইরে চলে গেছেন৷ শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা, সাবেক অনেক মন্ত্রী-এমপি এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকর্মী ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এদের মধ্যে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীও রয়েছেন৷ হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয় আওয়ামী লীগ। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর পর থেকে পদত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। সেদিনই আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর আত্মগোপনে চলে যান। শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী-িএমপিদের অনেকেই ওই দিনের পরপরই দেশের বাইরে চলে যান। আবার কেউ কেউ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ৫ আগস্টের আগেই দেশ ছাড়েন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৮ মাস হতে চললেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীকে এখনো আত্মগোপনেই থাকতে হচ্ছে।
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা অজ্ঞাত স্থান থেকে জানান, হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে, হাজারো নেতাকর্মীর নামে মামলা৷ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই আছে হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার আতঙ্কে। কখন গ্রেপ্তার হতে হয়, কখন হামলা হয়—এই আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যেই আমাদের দলের নেতাকর্মীদের দিন কাটছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমি নিজেও ঈদে বাড়ি যেতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আনন্দ আসবে কীভাবে! ভয়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ঈদের আনন্দ নিরানন্দ হয়ে গেছে।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীদের মধ্যে ১৮ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন৷ আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, দলটির ১৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন৷ তবে কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, এর সুনির্দিষ্ট তথ্য কেউ দিতে পারছেন না৷ নেতাদের কারো কারো মতে গ্রেপ্তার ১৫ হাজারেরও বেশি৷
কারাগারে থাকা উল্লেখযোগ্যরা হলেন—আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, শাজাহান খান, কাজী জাফরউল্লাহ, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম৷
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, যারা দেশের বাইরে আছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন—দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সুজিত রায় নন্দী, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক এমপি পংকজ দেবনাথ, আওলাদ হোসেন প্রমুখ৷
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পারায় অনেকে আর্থিক সংকটে রয়েছেন৷ ব্যবসা-বাণিজ্য এমন কি অনেকে বাড়িঘর সব হারিয়েছেন। এমন অবস্থায় টিকে থাকাই মুশকিল। ঈদ উৎসব নিয়ে তারা ভাবতে পারছেন না৷ তারা এখন টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এফপি/এস এন