বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও ইরানে সালামি বা ‘ঈদি’ নামে প্রথা বহু পুরনো। পরিবারের বড়দের কাছ থেকে ছোটরা এই উপহার পেয়ে থাকে, যা ঈদের খুশি আরও বাড়িয়ে তোলে। বংশ পরম্পরায় বাংলাদেশে এই প্রথা চলে আসছে। মনে করা হয়, ঈদের অন্যতম ঐতিহ্য সালামি। ছোট-বড় সবার মধ্যেই ঈদ আনন্দের বিশেষ উপলক্ষ সালামির আদান-প্রদান। আর ঈদের সালামি মানেই কড়কড়ে নতুন টাকার নোট। প্রতি বছর ঈদের সময় নতুন নোটের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে এ বছর নোটের নকশা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে নতুন টাকা ছাড়েনি। ফলে ব্যাংকের বাইরে সীমিতসংখ্যক নতুন নোট মিললেও, সেগুলো পেতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এতে ঈদে নতুন টাকার সালামি দেওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত দাম গুণতে না চাওয়ায় এবার অনেকেই নতুন নোট কিনছেন না। প্রতি ঈদে ১০-২০ হাজার টাকার নতুন নোট কিনতেন এমন ক্রেতারা এবার দাম বেশি থাকায় পুরনো নোটেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যাংকপাড়া মতিঝিলে নতুন নোট কিনতে গিয়ে হতাশ হয়েছেন মুগদার আহমেদ উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘প্রতিবার ১০-২০ হাজার টাকার নতুন নোট নেই। গতবার ২০ হাজার টাকার জন্য ৩ হাজার টাকা বেশি দিয়েছিলাম, এবার দাম এত বেশি যে নিতে পারলাম না। পুরনো নোট দিয়েই চলবে।’
বিক্রেতারা জানান, সাধারণত তারা বান্ডিল ভেঙে বিক্রি করেন না। তবে এবার বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে ১০-২০টি নোট করেও বিক্রি করছেন।
নতুন নোটের সংকট ও অতিরিক্ত দামের কারণে বাজারে কেনাবেচা কমে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। সাধারণত এমনিতেই ঈদের সময় ৫, ১০, ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার নতুন নোটের চাহিদা বেশি থাকে। তবে এবার সরবরাহ কম থাকায় খোলা বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে নতুন টাকা।
অবশ্য বিকল্প হিসেবে অনেকে বিভিন্ন কেনাকাটায় তুলনামূলক কিছুটা নতুন টাকা পেলে তা সংগ্রহ করে রেখেছেন ঈদে সালামি দেবেন বলে। সংবাদকর্মী সঞ্চিতা সীতু জানান, তিনি যখন শুনেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক এবার নতুন টাকা ছাড়বে না, তখন থেকেই বিভিন্ন কেনাকাটায় নতুন টাকা পেলে তা তিনি সংগ্রহ করে রাখছেন ঈদে শিশুদের সালামি দেবেন বলে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো সরবরাহ বন্ধ রাখায় ১ হাজার টাকার নতুন নোট কিনতে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৮০টি শাখা নতুন নোট বিনিময়ের অনুমতি পেলেও ১০ মার্চ এক ঘোষণায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ঈদ উপলক্ষে নতুন নোট বিতরণ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্তের নির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি। গুঞ্জন রয়েছে, নতুন নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে আপত্তির কারণেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জনপ্রিয় হচ্ছে নতুন নোটের বিকল্প সালামি-
এবার ঈদে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট না ছাড়লেও মানুষ বিকল্প ঈদ সালামি দেওয়া শুরু করেছেন। এখন ডিজিটাল যুগ। তাই সালামির ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে সালামি পাঠানোর সংস্কৃতি। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সহজেই অর্থ লেনদেন করা যাচ্ছে। ফলে এবার ঈদের সালামি দিতে ডিজিটাল মাধ্যম হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় বিকল্প।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা এবাদত হোসেন বলেন, ‘ঈদের ঐতিহ্য মনে করে এতোদিন ধরে নাতি-নাতনিদের ঈদের সালামি দিয়ে আসছি। এবার নতুন টাকা সংগ্রহ করতে না পারায় ডিজিটাল সালামিই ভরসা। তাদের ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ওয়ালেট রয়েছে, তাই এবার সেখানেই সালামি পাঠাবো।’
ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিন জানান, তিনি প্রতি বছর শখানেক ভাগনে-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি, ছোট ভাই-বোন ও সহকর্মীদের সালামি দেন। এবারও ঈদের আগে থেকেই বিকাশে একটি ‘সেন্ড মানি গ্রুপ’ তৈরি করেছেন, যাতে চাঁদ দেখার পরই সহজেই সবাইকে সালামি পাঠাতে পারেন। তার মতে, আগে চকচকে নতুন নোট দিয়ে সালামি দেওয়া হতো, এখন সেটা ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। আনন্দে কোনও ঘাটতি নেই।
শুধু ব্যক্তিগত লেনদেন নয়, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগও ডিজিটাল সালামিকে জনপ্রিয় করছে। বিকাশ ২০২১ সালে তাদের অ্যাপে ‘ঈদ সালামি এবং ঈদ শুভেচ্ছা’ ফিচার চালু করে। এই সেবার মাধ্যমে গ্রাহকেরা ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা সংযুক্ত করে সহজেই টাকা পাঠাতে পারেন। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বার্তা লেখার সুযোগ থাকছে।
যিনি সালামি পাবেন, তিনি বিকাশ অ্যাপে লগইন করলে একটি গিফট বক্স দেখতে পাবেন। বক্সে ক্লিক করলেই সালামির পরিমাণ ও পাঠানো বার্তা দেখা যাবে।
সালামির আবদারও ডিজিটাল
বর্তমানে ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধার কারণে বিকাশের মতো প্ল্যাটফর্মে সালামি পাঠানো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুধু পাঠানো নয়, সালামির আবদারও ডিজিটাল হয়েছে। কলেজ পড়ুয়া তানিয়া জানান, তিনি আত্মীয়দের ফোন করে সালামির আবদার জানাচ্ছেন, পাশাপাশি বিকাশ অ্যাপের রিকোয়েস্ট মানি ফিচার ব্যবহার করে সরাসরি সালামির অনুরোধও পাঠাচ্ছেন।
প্রযুক্তির কল্যাণে ঈদ সালামির প্রচলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। নগদ টাকার পরিবর্তে বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো প্ল্যাটফর্মে দ্রুত ও নিরাপদে সালামি আদান-প্রদান হচ্ছে। ঈদ আনন্দে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা, তবে ঐতিহ্য রয়ে গেছে অটুট।
ব্যাংকের মাধ্যমেও ডিজিটাল সালামি-
শুধু বিকাশ নয়, নগদ, রকেটসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের অ্যাপের মাধ্যমেও ডিজিটাল সালামি পাঠানো যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নেক্সাস পে, ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা, সিটি ব্যাংকের সিটিটাচসহ বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকেরা সহজেই ঈদের সালামি দিতে পারছেন।
নতুন নোট আসবে জুন-জুলাই-
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, জুলাইয়ে নতুন নোট বাজারে আসতে পারে। এর আগে পুরোনো নোট ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ভল্টে থাকা নতুন নোট ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ৫, ২০ ও ৫০ টাকার নোটের বিশাল পরিমাণ অলস পড়ে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর ছবিযুক্ত নোট বিতরণে বিতর্ক এড়াতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন নকশার নোট আসতে আরও কয়েক মাস লাগবে। সাধারণত নতুন নোট ছাপাতে ১২-১৮ মাস সময় লাগে, তাই জুনের আগে তা বাজারে আসার সম্ভাবনা কম।
বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা বলছেন, নতুন নোট বিতরণ না করতে পারায় ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও আপাতত এসব নোট ফেরত নিচ্ছে না।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বাজারে নতুন নোট না ছাড়লে অর্থের প্রবাহ কমে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এসএন