ঈদের খাবারের বৈচিত্র্য : বিশ্বের নানা স্বাদে ঈদুল ফিতর

ঈদুল ফিতর মানেই খুশি, নতুন পোশাক, সালামি আর একগাদা খাবারের মহোৎসব। এক দিনের জন্য হলেও ডায়েট শব্দটা গোপন করে রাখা হয় ডিকশনারির ভেতরে, আর পেট হয়ে ওঠে এক মহাসমুদ্র, যেখানে সেমাই, বিরিয়ানি, কাবাব সব ভাসতে থাকে নির্ভার! তবে আমাদের দেশেই শুধু নয়, ঈদুল ফিতরের খাবার উৎসব গোটা বিশ্বেই নানা রকম বৈচিত্র্যে ভরপুর। চলুন, এক চক্কর মেরে আসি ঈদের প্লেটগুলোর দুনিয়ায়!

বাংলাদেশ : সেমাই রাজত্ব ও রোস্ট বিপ্লব
বাংলাদেশে ঈদের সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাকের সামনে হাজির হয় গরম গরম দুধসেমাই আর লাচ্ছা সেমাই। তারপর পোলাও-কোরমা, রোস্ট-বিরিয়ানি আর শামি কাবাবের এমন আয়োজন চলে, যেন পুরো পরিবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে! মিষ্টি হিসেবে ফিরনি আর জর্দা না খেলে ঈদের দিন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশে ঈদুল ফিতরের দিনে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো সেমাই।

ভারত ও পাকিস্তান : নেহারি বনাম শাহি টুকরা
পাশের দেশগুলোতে ঈদের সকাল শুরু হয় গরম গরম নেহারি দিয়ে। ঝোলের মধ্যে নরম মাংস চুবিয়ে পরোটা দিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। আর মিষ্টির দিক দিয়ে শাহি টুকরা নামের এক অদ্ভুত কিন্তু স্বর্গীয় খাবার আছে, যেখানে পাউরুটির সঙ্গে কাজুবাদাম, দুধ আর চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হয় এক অপূর্ব স্বাদের ডেজার্ট।

সৌদি আরব : কবসা আর লুকাইমাতের ম্যাজিক
সৌদি আরবে ইদের দিন কবসা না থাকলে যেন উৎসবই জমে না। সুগন্ধি চাল, মাংস আর দারচিনি-এলাচের মিশ্রণে তৈরি এই খাবারটা খানদানি স্বাদ নিয়ে হাজির হয় সবার প্লেটে। আর ডেজার্টের দিক দিয়ে ছোট ছোট গোল মিষ্টি বল, লুকাইমাত, যা হালকা মধু বা সিরার মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন করা হয়। একবার মুখে দিলে মনে হবে, জীবন সুন্দর!

খেজুর, বাদাম, চিনি ও শুকনা নারকেল দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবারের চল আছে ইরাক ও সৌদি আরবে।
এটি ‘ক্লাইচা’ নামে পরিচিত। এটিকে ইরাক ও সৌদি আরবের জাতীয় বিস্কুট বলা হয়ে থাকে। এই খাবারই দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন—সিরিয়ায় এর নাম মামুল এবং মিসরে কাহাক।

তুরস্ক : বাকলাভার রাজত্ব
তুরস্কে ঈদের প্রধান আকর্ষণ বাকলাভা।
পাতলা স্তরের ময়দার শিটের ভেতরে বাদাম আর সিরা দিয়ে বানানো এই খাবারটি মুখে দিলে মিষ্টির স্বর্গে পৌঁছে যাওয়ার অনুভূতি হয়। আর দোনের কাবাব? ওহ, সেটা এমন এক বিস্ময়কর খাবার, যা ঈদের দিন না খেলে আত্মার শান্তি পাওয়া কঠিন!

মিসর : ফাতার ঐতিহ্য
মিসরে ঈদের দিন ফাতা খাওয়া রীতিমতো ঐতিহ্য। এটি মূলত ভাত, মাংস আর রসুন-ভিনেগারের এক অদ্ভুত কিন্তু সুস্বাদু মিশ্রণ। আর মিষ্টির দিক দিয়ে বাসবোসা নামের এক ধরনের সুজির কেক খাওয়া হয়, যার ওপর এক প্রকার মধুর সিরা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া : রেন্ডাংয়ের শক্তিশালী উপস্থিতি
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ইদের সময় রেন্ডাং না থাকলে উৎসবই অসম্পূর্ণ মনে হয়। এটি গরুর মাংসের এক বিশেষ রান্না, যা মসলা আর নারকেল দুধে ধীরে ধীরে রান্না করা হয়। এ ছাড়া ‘কেটুপাট’ নামে পামগাছের পাতায় মোড়ানো চালের কেকও বিশেষ জনপ্রিয়।

নাইজেরিয়া : সুয়া ও জোলফ রাইসের জয়জয়কার
নাইজেরিয়ায় ইদের দিন সুয়া নামের এক ধরণের মসলাদার গ্রিলড মাংস খাওয়া হয়। এর সঙ্গে জোলফ রাইস থাকে, যা দেখতে আমাদের বিরিয়ানির মতো হলেও স্বাদে বেশ আলাদা। এদের খাবারের ঝাল কিন্তু একদম চোখে পানি এনে দেওয়ার মতো!

মরক্কো : হারিরা স্যুপ ও মাখৌদা
মরক্কোতে ঈদের আগের দিন থেকেই হারিরা নামের এক ধরনের মসুর ডালের স্যুপ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। আর ঈদের দিন আলুর পাকোড়া বা মাখৌদা বেশ জনপ্রিয়। পকেটে যদি সালামির টাকা কম পড়ে, তাহলে এই স্যুপ আর পাকোড়া দিয়েই দিব্যি খুশি থাকা যায়!

রাশিয়া : মোমো বা ডাম্পলিংয়ের বাজিমাত
রাশিয়ায় ঈদের দিনে জনপ্রিয় খাবার মানতি। সহজ কথায় যাকে আমরা মোমো বা ডাম্পলিং বলি। মাখানো আটার পুটুলির মাঝে থাকে ভেড়া কিংবা গরুর মাংসের কিমার পুর। এরপর তা ভাপে সেদ্ধ করা হয়। মাখন আর ক্রিমের সঙ্গে এই ডাম্পলিং পরিবেশন করা হয়। তবে রাশিয়ায় অঞ্চলভেদে মানতির রেসিপি একেক রকম হয়ে থাকে। রাশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলিম।

চীন : মুচমুচে শানজি
ঈদে আগে চীনে দেখা মেলে তাদের জনপ্রিয় খাবার ‘শানজি’। চীনে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখের মতো মুসলিমের বসবাস। নুডলস ও চর্বি দিয়ে বানানো হয় খাবারটি। মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের কাছে এই খাবার খুবই জনপ্রিয়। ঈদের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই শানজিতে জমজমাট হয়ে ওঠে বাজার। ময়দার লেই দিয়ে মোটা করে নুডুলস বানিয়ে তা ভাজা হয় ডুবো তেলে। এরপর পিরামিডের মতো সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়।

বসনিয়া : আপেলের তুফাহিজা
‘তুফাহিজা’ বসনিয়ার এতিহ্যবাহী এক খাবার। এই বিশেষ রেসিপিটি ঈদসহ বিশেষ দিনে বসনিয়ানরা তৈরি করে থাকেন। আপেল সিদ্ধ করে তৈরি করা হয় বিশেষ এই পদ। সিদ্ধ আপেলের মধ্যে আখরোট বাদামে ভরাট করা হয় এবং হুইপড ক্রিম দিয়ে উপরে সাজানো হয়।

বিশ্বের যেখানেই যান, ইদের খাবারের বৈচিত্র্য দেখলেই বোঝা ম যায়, এই উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, বরং এটি এক বিশাল সাংস্কৃতিক মিলনও। সেমাই থেকে শুরু করে বাকলাভা, কবসা থেকে সুয়া—সব কিছুই এক অনন্য স্বাদের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, খাবারের আসল মজা তখনই আসে যখন সেটা সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া যায়!

এসএন 

Share this news on: