ট্রাম্পের শুল্ক: যে কারণে ভুগবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শতাধিক দেশের পণ্যে উচ্চহারে যে শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ এ অঞ্চলের অনেক দেশেরই পণ্য রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দ্য উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন, বিশ্বের সবথেকে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। এ দেশগুলো নানা রকমের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

“এ অঞ্চলের প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের চড়া শুল্ক দারুণভাবে আঘাত করবে,” সিএনএনকে বলেন কুগেলম্যান।

সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কার ওপর সবচেয়ে বেশি ৪৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এখনও আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, যে সংকটের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে আন্দোলন বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে পতন হয় গোটাবায়া রাজাপাকসে সরকারের। দেশটি এখনও নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্যাকেজের ওপর।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বড় প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের মুখোমুখি হবে। এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ, যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেল।

বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে তৈরি পোশাকের পারিমাণ ৭৩৪ কোটি ডলার। নতুন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সিএনএন বলছে, ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। ট্রাম্পের ঘোষণার ফলে পোশাক শিল্পে প্রতিযোগিতা কমে আসতে পারে, যাতে চাকরি হারাতে পারেন এ খাতের কর্মজীবীরাও।

নয়া দিল্লির ‘কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের’ অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর বলেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা পেলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশের পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের পর আমদানি করা মার্কিন পণ্যের শুল্কহার পর্যালোচনা করার ঘোষণা এসেছে বাংলাদেশ সরকার প্রধানের দপ্তর থেকে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেন, “বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর প্রযোজ্য শুল্কহার পর্যালোচনা করছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দ্রুততম সময়ে শুল্ক যৌক্তিককরণের বিকল্পগুলো খুঁজে বের করবে, যা এ বিষয়ে কার্যকর সমাধানের জন্য জরুরি।”

প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন 'রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ' নীতির অংশ হিসেবে শতাধিক দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষ্য, মার্কিন রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে যেসব দেশ উচ্চ শুল্কের বাধা তুলে রেখেছে, তাদের তথাকথিত সেই ‘অন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলন’ মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন পদক্ষেপ।

বিষয়টি নিয়ে প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ এবং বৃহত্তম বড় রপ্তানি গন্তব্য।

“ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে কাজ করে আসছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আমাদের চলমান আলোচনার মাধ্যমে শুল্কের বিষয়টির সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে আশা করছি।”

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ২৬ শতাংশ শুল্‌ক আরোপে ভারত ধাক্কা খেলেও এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মত প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন কুগেলম্যান।

তিনি বলেন, নয়া দিল্লি নিজেকে রক্ষায় ওয়াশিংটনকে আগে অনেক ছাড় দিলেও সেটি কাজে আসেনি। ফলে এখন ‘ভরসার পথ’ হল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, আর দিল্লি সে চেষ্টাই করছে। সেরকম কিছু হলে উভয়পক্ষেরই শুল্ক কমাতে হতে পারে, তাতে ভারত কিছুটা পরিত্রাণ পাবে।

ভারতের ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ ও ‘কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের’ প্রধান প্রবীণ খানদেলওয়াল বলেন, আমেরিকা ও ভারতের বাণিজ্যে কীভাবে শুল্কের প্রভাব কমিয়ে আনা যায়, সেজন্য সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবে।

সম্প্রতি ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের ওপরও ৪৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী এ দেশটিতে চার বছর ধরে গৃহযুদ্ধ লেগে আছে। ভূমিকম্পে ৩ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানির মধ্যেই সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কের বোঝা চেপেছে বিশ্বের সবথেকে দারিদ্র্য দেশগুলোর ওপরও, যারা ইতোমধ্যে গৃহযুদ্ধ আর ব্যাপক অর্থ সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

সিএনএন জানিয়েছে, সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ শুল্কের চেয়েও বেশি আরোপ করা হয়েছে দুর্দশাগ্রস্ত পাঁচটি দেশের পণ্যের ওপর।

এর মধ্যে ডিআর কঙ্গো ১১ শতাংশ, মাদাগাস্কার ৪৭ শতাংশ, মোজাম্বিক ১৬ শতাংশ, মালাউই ১৮ শতাংশ ও সিরিয়া ৪১ শতাংশ। বিশ্বের সবেচেয় দারিদ্র্য ২৬টি দেশের মধ্যে রয়েছে এ পাঁচটি দেশ।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, এই দেশগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতির মাত্র ০.৫ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বের মোট গরীবের ৪০ শতাংশই রয়েছে এ পাঁচটি দেশে।

দক্ষিণ আফ্রিকা উপকূলের মাদাগাস্কারে আড়াই কোটি মানুষের বাস। সেখানকার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্য, যাদের আয় দৈনিক ২ দশমিক ১৫ ডলারের কম।

এ দেশটির দ্বিতীয় বড় রপ্তানি বাজার হল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালে মাদাগাস্কার যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে রয়েছে ভ্যানিলা, পোশাক, টাইটেনিয়াম ও কোবাল্ট।

ভেনিজুয়েলারও সবথেকে বড় বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। অর্থ সংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া এ দেশটির ওপরও ট্রাম্প প্রশাসন ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশটি থেকে।

এফপি/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে : আলতাফ হোসেন চৌধুরী Nov 06, 2025
img
সালমানের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতার মামলা Nov 06, 2025
img
গণসংযোগে নিহত সরওয়ার বিএনপির কেউ নন : আমীর খসরু Nov 06, 2025
img
চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিলেন বিএনপির ২৮ নেতাকর্মী Nov 05, 2025
img
ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে : বাবুল Nov 05, 2025
img
চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের Nov 05, 2025
img
কুসিকের বিএনপিপন্থি সাবেক কাউন্সিলররা সমর্থন জানালেন মনিরুল হককে Nov 05, 2025
img
রাতে ব্রুজের বিপক্ষে অনিশ্চিত লামিনে ইয়ামাল! Nov 05, 2025
img
মুঞ্জ্যা’র মূল চরিত্রে ভাবা হয়েছিল শ্রদ্ধা কাপুরকে! Nov 05, 2025
img
নেত্রকোনার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক গ্রেপ্তার Nov 05, 2025
img
পদ্মার ন্যায্য পানি বণ্টনের দাবিতে বিএনপির সমাবেশ Nov 05, 2025
img
মামদানির সাফল্যে তার মায়ের বার্তা Nov 05, 2025
img
এনসিপি অচিরেই তাদের ভুল বুঝতে পারবে: মুনতাসির মাহমুদ Nov 05, 2025
img
নতুন অধ্যায়ের সন্ধানে শ্রীলীলা! Nov 05, 2025
img
পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা শুরু করতে পারে রাশিয়া Nov 05, 2025
img
আমির-সালমানের অদ্ভুত জুটি, আজও দর্শকদের প্রিয় Nov 05, 2025
img
নির্বাচনেই জাতির ভাগ্যের ফয়সালা হবে: জামায়াত আমির Nov 05, 2025
img
সংগীত চর্চায় সৌদি সরকার নিচ্ছে বড় পদক্ষেপ Nov 05, 2025
img
শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ রাষ্ট্রপতির কাছে নেই: হাবিবুর রহমান হাবিব Nov 05, 2025
img
বিবাহবিচ্ছেদের গুঞ্জনে ঐশ্বরিয়ার স্পষ্ট জবাব! Nov 05, 2025