৮ গ্রুপের পাচার করা অর্থ ফেরাতে উদ্যোগ

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকঋণের নামে অর্থ লোপাট, ঘুষ গ্রহণ ও রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। এর মধ্যে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত সামিট গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপের নামে-বেনামে পাচার করা বিপুল অর্থের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) যৌথ তদন্ত সংস্থাগুলো।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সূত্র জানায়, মূলত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, হংকং, স্লোভাকিয়া, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থসম্পদ পাচার ও বিনিয়োগের প্রমাণ মিলেছে। এসব সম্পদ দেশে ফেরাতে ইতিমধ্যে ৮টি দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
পতিত সরকারের টানা তিন মেয়াদে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার অর্থ পাচারের অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

সূত্র জানায়, পাচারকৃত অর্থের সঙ্গে সামিট, এস আলম, সিকদার, আরামিট, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), টাস্কফোর্সসহ তদন্তসংশ্লিষ্ট ৯টি সংস্থা। এসব শিল্প-বাণিজ্য গ্রুপের কয়েকজন কর্ণধার গোপনে বিদেশি নাগরিকত্বও নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে তথ্য পাওয়া এবং তা ফেরত আনার লক্ষ্যে সুইজারল্যান্ডসহ ৯টি দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পর্যায়ক্রমে চিঠি দিচ্ছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, টেলিকম, বিদ্যুৎ ও বন্দর খাতে সামিট গ্রুপ ব্যাপক অনিয়ম করেছে। গ্রুপটির প্রকৃত মালিক শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের ভাই আজিজ খান। গ্রুপটি প্রভাব খাটিয়ে বিদ্যুৎ, টেলিকম ও বন্দর খাতে ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। অনুসন্ধানে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে সামিটের নামে-বেনামে সম্পত্তি থাকার প্রমাণ মিলেছে। গ্রুপটি সিঙ্গাপুরে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও অনুমতি রয়েছে মাত্র ৭০ মিলিয়ন ডলারের। চট্টগ্রামের বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করেছেন খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। সরকারের একাধিক সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্তে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় তাঁদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান মিলেছে। এসব সম্পদের উৎসসহ কোনো তথ্য নেই।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে যুক্তরাজ্যে ৮ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড (১ হাজার ১৩ কোটি টাকা) পাচারের তথ্য রয়েছে। লন্ডনে সালমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের নামে সাড়ে ৭৭ লাখ পাউন্ডের (১২৬ কোটি টাকা) দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। নাসা গ্রুপের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে ব্যাংকঋণের ৬৭০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য রয়েছে। নাসা গ্রুপ যুক্তরাজ্য এবং দেশটির অধীনস্থ আইল অব ম্যান ও জার্সি এবং চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হংকংয়ে ৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড বা ৬৪৪ কোটি টাকার সম্পদ পাচার করেছে।

সূত্র আরও জানায়, হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের মালিকানাধীন কোম্পানি আরামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ পাচারের তথ্য মিলেছে। এসব সম্পদ উদ্ধারে তিনটি দেশের সঙ্গে এমএলএআর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেমকন গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। সিকদার গ্রুপের কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রুপটির বিভিন্ন পরিচালকের নামে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সম্পত্তির তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ওরিয়ন গ্রুপের পরিচালকদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র ডমিনিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের আলবেনিয়ায় বিনিয়োগের তথ্য রয়েছে। পরিচালকেরা গোপনে দেশ দুটোর নাগরিকত্বও নিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে বলেন, অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানো অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। যাঁরা বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন, তাঁদের সম্পদ ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউর নাকের ডগায় বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে, যা ফেরত আনা সম্ভব। তবে অত্যন্ত কঠিন কাজ। পাচারের টাকা ফেরত আনতে বিএফআইইউ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিআইডি, দুদক ও আটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।


এমআর/টিএ


Share this news on:

সর্বশেষ

img
শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে : আলতাফ হোসেন চৌধুরী Nov 06, 2025
img
সালমানের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতার মামলা Nov 06, 2025
img
গণসংযোগে নিহত সরওয়ার বিএনপির কেউ নন : আমীর খসরু Nov 06, 2025
img
চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিলেন বিএনপির ২৮ নেতাকর্মী Nov 05, 2025
img
ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে : বাবুল Nov 05, 2025
img
চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের Nov 05, 2025
img
কুসিকের বিএনপিপন্থি সাবেক কাউন্সিলররা সমর্থন জানালেন মনিরুল হককে Nov 05, 2025
img
রাতে ব্রুজের বিপক্ষে অনিশ্চিত লামিনে ইয়ামাল! Nov 05, 2025
img
মুঞ্জ্যা’র মূল চরিত্রে ভাবা হয়েছিল শ্রদ্ধা কাপুরকে! Nov 05, 2025
img
নেত্রকোনার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক গ্রেপ্তার Nov 05, 2025
img
পদ্মার ন্যায্য পানি বণ্টনের দাবিতে বিএনপির সমাবেশ Nov 05, 2025
img
মামদানির সাফল্যে তার মায়ের বার্তা Nov 05, 2025
img
এনসিপি অচিরেই তাদের ভুল বুঝতে পারবে: মুনতাসির মাহমুদ Nov 05, 2025
img
নতুন অধ্যায়ের সন্ধানে শ্রীলীলা! Nov 05, 2025
img
পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা শুরু করতে পারে রাশিয়া Nov 05, 2025
img
আমির-সালমানের অদ্ভুত জুটি, আজও দর্শকদের প্রিয় Nov 05, 2025
img
নির্বাচনেই জাতির ভাগ্যের ফয়সালা হবে: জামায়াত আমির Nov 05, 2025
img
সংগীত চর্চায় সৌদি সরকার নিচ্ছে বড় পদক্ষেপ Nov 05, 2025
img
শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ রাষ্ট্রপতির কাছে নেই: হাবিবুর রহমান হাবিব Nov 05, 2025
img
বিবাহবিচ্ছেদের গুঞ্জনে ঐশ্বরিয়ার স্পষ্ট জবাব! Nov 05, 2025